‘শ্রীলঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ যখন শুরু হলো, তখন দেখলাম এটির অন্যতম স্পনসর এমটিএফই। আমি আস্থা পেলাম। আবার বিনিয়োগ করলাম। কিন্তু ৬ আগস্ট দেখলাম, এমটিএফই থেকে টাকা আমার ওয়ালেটে যাচ্ছে না। তখন শুনলাম, কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটা হচ্ছে। এরপর ১৮-১৯ আগস্ট দেখলাম, এমটিএফই অ্যাপে সবকিছুই বন্ধ।’লালমনিরহাটের এক কলেজছাত্র বলেন এসব কথা । তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। তাঁর মতো বাংলাদেশের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, স্বল্প-মধ্যম আয়ের মানুষ এমটিএফইতে অর্থ বিনিয়োগ করে এখন কোনো অর্থই তুলতে পারছেন না বা হাতে পাচ্ছেন না।
এমটিএফইতে হারিয়ে ফেলা এই অর্থের পরিমাণ কম নয়। ধারণা করা হচ্ছে, কোটি কোটি টাকা এমটিএফইর কাছে চলে গেছে। কুষ্টিয়ার এক চাকরিজীবী নারী জানান, এক বন্ধুর কাছে শুনে মাসখানেক আগে এমটিএফইতে ঢুকে ৬১ ডলারের সমপরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর কোনো লাভ বা অর্থ তিনি পাননি। তিনি জানালেন, তাঁদের খোকসা উপজেলার শুধু গোপগ্রাম ইউনিয়ন থেকেই চলে গেছে এক কোটি টাকার মতো। তাহলে ধারণা করা যায়, এমটিএফইতে অনেক টাকা বাংলাদেশের মানুষ খুইয়েছেন।
লালমনিরহাটের সেই ছাত্রের সঙ্গে যে বিষয়ে কথা হলো, সেটি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড। এটি অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যেমন বিটকয়েন) কেনাবেচার কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। এমটিএফই অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকদের ভার্চ্যুয়াল শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানায় এবং লেনদেন পরিচালনা করে। কানাডা ও দুবাইভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হলেও এটি আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় বেশি। লাভের পরিমাণ বেশি, এই আশায় লাখ লাখ মানুষ এমটিএফই ও এমন আরও অ্যাপের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেন। অনেকে কিছু লাভও পেয়েছেন। তবে চূড়ান্ত বিচারে বিনিয়োগের সব অর্থই খোয়াতে হয়। কয়েক দিন ধরে এমটিএফইয়ের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে।
এমটিএফই ব্যবহারকারীদের অনেকগুলো ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। একটি গ্রুপে বয়স্ক এক ব্যক্তি লিখেছেন, ‘আমি গরু বিক্রি করে টাকা খাটিয়েছি। আমার লাখ টাকা শেষ।’ আরেকজন ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা এখানে বিনিয়োগ করেছেন, তিনিও লিখেছেন, এমটিএফইতে ঢোকা যাচ্ছে না। টাকা পাবেন কি না, জানেন না। আরেকজন শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খাটিয়েছেন, এখন হতাশ।
এমটিএফই বাংলাদেশে চলতি বছরই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ভার্চ্যুয়াল আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার বা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের প্রলোভন দেখায়। পুঁজিবাজারে, যেমন ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে লেনদেন করতে হয়, এমটিএফইর মতো অ্যাপ বা কোম্পানিগুলো একধরনের ভার্চ্যুয়াল ব্রোকারেজ হাউস হিসেবে কাজ করে। সবাইকে ফোরেক্সে বিনিয়োগের কথা বলে, কয়েকজনকে কিছু লাভ পাইয়ে দিয়ে, তাদের দিয়ে প্রচারণা করিয়ে, অনেকে যখন বিনিয়োগ করেন, তখন কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায়। এমটিএফইও আদতে সে রকম পঞ্জি স্কিম।
লালমনিরহাটের সেই ছাত্র জানান, এমটিএফইতে ন্যূনতম ৬১ মার্কিন ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়। এই বিনিয়োগে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লাভ হবে, এটা বলা হয়। এখানেই হাজার হাজার গ্রাহক আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এমটিএফইর বিনিয়োগ কোথায় খাটানো হয়? বেশ কিছু ভার্চ্যুয়াল শেয়ারবাজার আছে। এমটিএফইর বাংলাদেশি গ্রাহকেরা বাইন্যান্স নামের অনলাইন বাজার বা মার্কেটপ্লেসে ক্রিপ্টোকারেন্সি, ডলার কেনাবেচা করেন। বাইন্যান্স বাংলাদেশে জনপ্রিয় বেশি। সেই ছাত্র বললেন, এমটিএফইর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির একটি চ্যাটবট এসে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় এই কেনাবেচা পরিচালনা করে লাভের হিসাব দেয়। এটি শনি ও রোববার বন্ধ থাকে। আরও এক দিন এআই চ্যাটবটের ‘বিশ্রাম’ থাকে। বাইন্যান্সে বাংলাদেশ থেকে সপ্তাহে চার দিন কেনাবেচা করা যায়। ১৮ আগস্টের পর থেকে এই এআই রোবট আর চালুই হচ্ছে না।
পুরোটাই ভার্চ্যুয়াল এক ব্যবস্থা। তাহলে কড়কড়ে সত্যিকারের টাকার লেনদেন কীভাবে হয়? শুরুতে এমটিএফইতে অ্যাকাউন্ট খুলতে ভোটার আইডি, নাম–ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর লাগত। পরে শুধু মুঠোফোন নম্বর দিয়েই এমটিএফইতে হিসাব খোলা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের আইন অনুযায়ী, দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার লেনেদেন বা কেনাকাটা অবৈধ। শুধু ঋণপত্র (এলসি) খুলে বা আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন করা যায়।
এমটিএফই থেকে পাঠানো বাংলাদেশের কোনো একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নির্দিষ্ট নগদ, বিকাশ বা রকেট নম্বরে গ্রাহক টাকা পাঠান। সেই প্রাপকের কাছ থেকে টাকা বিদেশে থাকা এমটিএফইর এজেন্ট বা প্রতিনিধির কাছে চলে যায়। এভাবে বিনিয়োগ চলতে থাকে। ওদিকে বাইন্যান্সে শেয়ার বা ডলার কেনাবেচার পর অর্থ পয়েন্ট হিসেবে এমটিএফইতে থাকা গ্রাহকের ওয়ালেটে জমা হয়। সেখান থেকে অর্থ উত্তোলন (উইথড্র) করতে হয়। সেই টাকা আবার বিদেশ থেকে নগদ, বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে দেশে গ্রাহকের কাছে চলে আসে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে যেহেতু বিদেশ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি অর্থ পাঠানো যায় না, তাই যাঁরা এই পঞ্জি স্কিমের বড় খেলোয়াড়, তাঁরা অসংখ্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলে কাজটা সারেন। আবার অনেক নম্বরে দেখা যায় টানা ছোট ছোট লেনদেন হচ্ছে। এগুলো হলো অস্বাভাবিক বা অবৈধ লেনদেনের লক্ষণ।
বাংলাদেশে এমটিএফইর কোনো কার্যালয় নেই। তবে অনেক সিও এখানে আছেন। ৩০ জন গ্রাহক বানালেই এমটিএফই তাঁকে সিও বানিয়ে দেয়। লালমনিরহাটের সেই ছাত্র জানালেন, সিওদের সঙ্গেও ফোন আর কোড নম্বরের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়। এ ছাড়া সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ নেই। তবে কিছু কিছু সিওর অফিস ছিল বলে কয়েকজন জানালেন।
ইভ্যালি স্ক্যামের রেশ কাটতে না কাটতেই এখন এই এমটিএফই স্ক্যামের ঘটনা। পরিশ্রম না করে সহজে টাকা রোজগারের লোভে পড়ে দেশজুড়ে অসংখ্য মানুষ নিজেদের টাকা খুইয়েছেন, তা এখন পরিষ্কার। হাজার হাজার টাকার গুণিতক হিসাবে এই টাকার পরিমাণ হয়তো শতকোটি টাকা। ভার্চ্যুয়াল ও বাস্তব ব্যবসার মডেল দেখিয়ে ইভ্যালি ছিল পঞ্জি স্কিমের চরম এক রূপ। এমটিএফই ভার্চ্যুয়াল পঞ্জি স্কিম, একইসঙ্গে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম মডেলেও কাজ করে তারা। এমটিএফই কি বিশ্বস্ত? এই প্রশ্ন লিখে গুগল করলে বেশির ভাগ উত্তরই আসে নেতিবাচক।
বাংলাদেশের আইনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশি পুঁজিবাজারে লেনদেন অবৈধ। কিন্তু ইন্টারনেটের এই যুগে নানা অ্যাপের মাধ্যমে অনেকেই এই লেনদেন করে থাকেন। বেশির ভাগ মার্কেটপ্লেস পেপ্যালের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করে। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় পেমেন্ট গেটওয়ে পেপ্যাল বাংলাদেশে এখনো অনুমতি পায়নি। ফলে টাকা পেলেও ভিন্ন পথে, মানে অবৈধভাবে দেশে আনতে হয়। ফলে সেই সুযোগ নিয়ে প্রতারক চক্র হাজার হাজার মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়। পেপ্যালসহ বিভিন্ন গেটওয়ে বাংলাদেশে চালু থাকলে অন্তত সরাসরি বৈধ লেনদেন করার সুযোগ থাকে।
এ রকম স্ক্যামের পরপর যেমন হয়, এমটিএফইর বেলাতেও আজ তা–ই দেখা যাচ্ছে। ফেসবুকে এমটিএফইর গ্রুপগুলোতে প্রায় সবার আশঙ্কা আর হতাশার কথা দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সুবিধাপ্রাপ্ত বা কোনো না কোনোভাবে এমটিএফইর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নাম–পরিচয় ছাড়া ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। বলছেন, এখনো কোনো বিপদ দেখছেন না, কারিগরি ত্রুটির কারণে এমন হচ্ছে। এই সপ্তাহেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘আমিও তো ইনভেস্টর, আমারও তো আপনাদের মতো টাকার মায়া আছে।’ ‘এটা সাময়িক, সমস্যার সমাধান হবে।’
কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এমটিএফই আগে ভারত থেকে পরিচালিত হতো। কিন্তু ভারতে আইনি বিধিনিষেধের কারণে এ রকম লেনদেন করা যায় না। তাই লেনদেন চলে দুবাই থেকে। দুবাই এসব প্রতারণামূলক স্কিম চালানোর স্বর্গ হয়ে উঠেছে।
এমটিএফই ঘিরে তৈরি হওয়া বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জের বিষয়টি হলো, সরকারকে জানিয়ে তো কেউ এসব অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে বিনিয়োগ করেনি। ডেসটিনির বেলায় প্রতারণার অনেক অভিযোগ এসেছে। এমটিএফই নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও তারা কিছু বলতে চায় না। এর কারণ, তারাও তো হুন্ডির মাধ্যমে টাকা খাটিয়েছে। তবু ডিজিটাল প্রতারণা ও সাধারণ অপরাধ—দুই অংশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিষয়টি দেখতে বলা হয়েছে। তবে ডিজিটাল দুনিয়ায় এসব প্রতারণা এড়াতে সচেতন হওয়া ও আইন মেনে চলার বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস—বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, ‘ডেসটিনি থেকে ই–ভ্যালি, তারপর এই এমটিএফইর ঘটনা থেকে বোঝা যায় আমাদের দেশে নৈতিকতা ও শিক্ষার অবক্ষয় হয়েছে। অতীত থেকে কেউ শিক্ষা নেয়নি। তবে প্রশাসনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এমটিএফইয়ের কার্যক্রম অনেকদিন থেকেই চলছে। যেখানে সরকারের ফেসবুকসহ নানা অনলাইন মাধ্যম মনিটর করার টুল আছে, সেখানে এমটিএফইর কার্যক্রম কেউ খেয়াল করল না, এই দায়িত্ব এড়ানো যাবে না।’
রাজশাহীতে এমটিএফই বিষয়ে একটি মামলাও হয়েছে। তবে সে মামালার তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই।এমটিএফই অ্যাপ ব্যবহার করে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার অভিযোগে রাজশাহীতে দায়ের হওয়া মামলায় ২৮ দিনেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। গত ২৩ জুলাই আইনজীবী জহুরুল ইসলাম রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করেন। এতে ‘এমটিএফই’ ছাড়াও ‘আলটিমা উইলেট’ অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারণার কথা উল্লেখ করা হয়। আদালতের বিচারক জিয়াউর রহমান আরজিটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করার জন্য নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তদন্তের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনটি সংস্থার তিনজন কর্মকর্তাকে যৌথভাবে এই মামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। পর দিন মামলাটি থানায় রেকর্ড করা হয়। রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল হক বলেন, তদন্ত চলছে। যতটুকু জানা গেছে, কয়েকটি লেভেলে প্রতারণা হয়েছে। রাজশাহীতে যাঁরা জড়িত, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে একজন আরেকজনের দ্বারা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এ পর্যন্ত এই মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।’
এমটিএফই বেশ কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ বিনিয়োগ করছে, যা বাংলাদেশের আইনে অবৈধ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বা সাইবার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কোনো সংস্থাই সাধারণ মানুষদের সচেতন করার কাজটি করেনি। এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা যে কত জরুরি, তা আমাদের আর কত ঠেকে ঠেকে শিখতে হবে।
গোনিউজ২৪/আর এ জে
আপনার মতামত লিখুন :