দেশে বড় হচ্ছে সুকুক বাজার। শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি বন্ড ‘সুকুক’ ইস্যু করে সরকার। এই বন্ডে বিনিয়োগ করে উপকার পাচ্ছে ইসলামি ধারার ব্যাংকের পাশাপাশি কনভেনশনাল (প্রচলিত) ব্যাংকগুলোও। এরইমধ্যে এই বন্ড ছেড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলেছে সরকার। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক এই বন্ড বিক্রি করছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ থাকায় নতুন করে আবারও দুই হাজার কোটি টাকার ৫ বছর মেয়াদি সুকুক বন্ড বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। দুই ধাপে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে ওই বন্ড ইস্যু হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ‘ক্যাশ অ্যান্ড ডেবিট ম্যানেজমেন্ট কমিটি’র (সিডিএমসি) এক সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ।
এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, সিডিএমসি’র ৫২তম সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানেই উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত এসেছে।
সাধারণত, সুকুকে বিনিয়োগকারীও লভ্যাংশ পান। এই বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ থাকে না। সুদ না থাকায় ইসলামি ব্যাংকগুলো এখানে টাকা রাখতে পারে। শুধু তাই নয়, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে তফসিলি ব্যাংকের গঠন করা ২০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিলও সুকুক বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সুকুকে বিনিয়োগের সুযোগ পেয়েছে ব্যাংকগুলো। এদিকে ইজারা সুকুক বন্ড শেয়ার বাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটেও লেনদেনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে সুকুক কেনায় উৎসাহ কিছুটা কমলেও বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোর আগ্রহে কিছু টাকা ফিরে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, শরিয়াহভিত্তিক কনভেনশনাল ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডো ও শাখার ২০২৩ সালে নভেম্বরভিত্তিক বিবরণী পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান। এছাড়া কনভেনশনাল ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ৩ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, দেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ‘সারা দেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প’ নামে প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য সর্বপ্রথম সুকুক বন্ড (ইজারা সুকুক) ইস্যু করা হয়। এ নিয়ে ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ।
আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এডিবির পরামর্শে ‘সুকুক বন্ড’ নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার। সরকার ২০১৯ সালের ২৯ মে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) মাধ্যমে সুকুক বিষয়ে সর্বপ্রথম গেজেট প্রকাশ করে। পরে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন আকারে ২০২০ সালের ৮ অক্টোবর শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায় সরকার কর্তৃক সুকুক ইস্যু ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত গাইড লাইন জারি করে। এই গাইডলাইন অনুসরণ করে স্পেশাল পারপাস ভেহিকল (এমপিভি) হিসেবে ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ‘ইসলামিক সিকিউরিটিজ সেকশন’ ইতোমধ্যে তিনটি সুকুক ইস্যু করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম দফায় সরকার নিরাপদ পানি সরবরাহের একটি প্রকল্পে আট হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ইস্যু করেছিল। এটিই সরকারের উদ্যোগে চালু হওয়া প্রথম ইসলামি বন্ড। পরের বছর আরও ১০ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ইস্যু করা হয়। যার মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ব্যয় মেটাতে সুকুক বন্ড ইস্যু করে ৫ হাজার কোটি টাকা তোলা হয় ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
পরে ২০২২ সালের ১৭ এপ্রিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন (আইআরআইডিপি)-৩-এর ‘নির্মাণ ও উন্নয়ন’ নামে সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার সুকুক ইস্যু করে। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখা এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ বন্ডটি কিনেছে। শুরুতে শুধু অভিহিত মূল্যে এই সুকুক কেনাবেচার সুযোগ ছিল।
প্রসপেক্টাস অনুযায়ী, বার্ষিক ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ রেন্টাল হারে ‘ইসতিসনা’ ও ‘ইজারা’ পদ্ধতিতে ৫ হাজার কোটি টাকার আইআরআইডিপি-৩ সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট সুকুক ইস্যু করা হয়। সরকার প্রথাগতভাবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন বা সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এসব বন্ড সুদভিত্তিক। শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানিগুলো সুদভিত্তিক বন্ড কিনতে পারে না। এ অবস্থায় মুনাফা বা ভাড়াভিত্তিক শরিয়াহ বন্ড ইস্যু করছে সরকার।
বর্তমানে ইস্যু করা সুকুকের ৮৫ শতাংশে বিনিয়োগ করতে পারে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিমা কোম্পানি। ১০ শতাংশে বিনিয়োগ করতে পারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইসলামিক শাখা ও উইন্ডোজ। বাকি ৫ শতাংশে বিনিয়োগের সুযোগ থাকে সাধারণ মানুষের।
বেসরকারি খাতে সুকুক
সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাত প্রথম সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ শুরু করে দেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়িক গ্রুপ বেক্সিমকো। ২০২১ সালের ১৩ জানুয়ারি শেয়ার বাজারে শরিয়াহ্ভিত্তিক বন্ড ‘বেক্সিমকো গ্রিন সুকুক আল-ইসতিসনা’ আইপিও এবং প্রাইভেট প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়ায় ইস্যু করে মোট ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে বেক্সিমকো গ্রুপ। সুকুকটির অভিহিত মূল্য ১০০ টাকা।
এদিকে গত বছর আরএফএল গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বঙ্গ বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস লিমিটেড (বিবিএমএল) দেশের দ্বিতীয় করপোরেট সুকুক বন্ড ইস্যু করে ৩০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। বন্ডটি দেশের ব্যাংকগুলোতে ইস্যু করা হয়েছিল, যেখানে সিটি ব্যাংক ক্যাপিটাল অ্যারেঞ্জার ও ইস্যু উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছে।
ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)
এক হাজার কোটি টাকার ‘আইসিবি ফার্স্ট মুদারাবা সুকুক’ বন্ড ইস্যুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের কোম্পানি আইসিবি। সুকুকটি হবে ১০ বছর মেয়াদি, যার অভিহিত মূল্য এক হাজার টাকা।
দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রকৌশল খাতের কোম্পানি দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেড সুকুকের মাধ্যমে ৫০০ কোটি টাকা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের অর্থের উৎস হিসেবে সুকুক ইস্যুর কথা ভাবছে।
আপনার মতামত লিখুন :