আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় এখন। তবে আপনার আয়কর নথি বা ফাইলে যদি সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত, ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) আমানতের সঠিক বিবরণ না থাকে, তাহলে বিপত্তি ঘটতে পারে। সঠিকভাবে হিসাবভুক্ত না হলে পরে খেসারত দিতে হয়। গুনতে হয় অতিরিক্ত কর। এমনকি জেল বা জরিমানাও হতে পারে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, করদাতার একাধিক ব্যাংক হিসাব থাকলেও আয়কর নথিতে সব তথ্য না দিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন। কিংবা প্রদর্শন করা ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আয়কর নথিতে যে আয় দেখানো রয়েছে, তার থেকে ব্যাংক লেনদেন বেশি। অর্থাৎ আয়কর রিটার্নের সঙ্গে মিল নেই, করদাতার এ রকম একাধিক লেনদেন থাকতে পারে।
মনে রাখা দরকার, আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পর বিভিন্ন সময় তা পর্যালোচনা করার বিধান রয়েছে। এ কারণে ভবিষ্যৎ-বিপত্তি এড়াতে আয়কর নথিতে সঠিকভাবে হিসাবভুক্ত হওয়া প্রয়োজন।
নিয়মিত পর্যালোচনা হয় আয়কর রিটার্ন
এক. আয়কর আইনের ১৭৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো করদাতার আয়-ব্যয় ও সম্পদ বিবরণীর তথ্যে গরমিল থাকলে জমাকৃত রিটার্ন অসম্পূর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এ ক্ষেত্রে উপকর কমিশনার কারণ উল্লেখপূর্বক করদাতার নিকট সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাই, বিবৃতি বা দলিলাদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দাখিল করার জন্য নোটিশ প্রেরণ করবেন।
দুই. জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রতিবছর কিছু নথি নিরীক্ষা (অডিট) করা হয়। কিছু নথি যুগ্ম বা অতিরিক্ত কর কমিশনারের মাধ্যমে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়, যাকে আয়করের ভাষায় ‘অর্থোডক্স’ বলা হয়। কর পরিদর্শন বিভাগ বা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল কিছু নথি পর্যালোচনা করে থাকে।
তিন. উপকর কমিশনার (ডিসিটি) যেকোনো সময় যুগ্ম কর কমিশনার বা অতিরিক্ত কর কমিশনারের অনুমতি সাপেক্ষে ২১২ ধারায় ফাইল পুনঃ উন্মোচন করতে পারেন। আয়কর আইনে ছয় বছর পর্যন্ত আয়কর নথি পুনরায় উন্মোচন করা যায়।
চার. এ ছাড়া আয়কর কার্যালয় বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক হিসাব অনুসন্ধান করে তথ্য বের করে থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের তথ্যভান্ডার বা ডেটাবেজ (যেমন—সঞ্চয় অধিদপ্তর) এখন স্বয়ংক্রিয় (অটোমেশন) হয়ে এনবিআরের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ফলে সেখান থেকেও তথ্য অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র, স্থায়ী আমানত বা ডিপিএস আমানতের সঠিক বিবরণ আয়কর নথিতে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে করণীয়
যে অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র কেনা হয়, সেই বছরে নির্দিষ্ট হারে আয়করের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ রেয়াত পাওয়া যায়। তবে সঞ্চয়পত্র কেনার সংশ্লিষ্ট বছরেই কেবল আয়কর রেয়াত পাওয়া যাবে, একই সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে পরবর্তী কোনো বছর এই রেয়াত সুবিধা পাওয়া যাবে না। অর্থ আইন ২০২৩-এর ষষ্ঠ তফসিলের ন্যায় ৭ অনুযায়ী, ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করলে আয়কর রেয়াত পাওয়া যাবে।
সঞ্চয়পত্র থেকে যে সুদ পাওয়া যায় এবং যে পরিমাণ টাকা উৎসে আয়কর হিসেবে কেটে রাখা হয়, সেটাই চূড়ান্ত কর দায়। যেমন মনে করি জনাব জাফর সঞ্চয়পত্র থেকে ৫ লাখ টাকা সুদ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ উৎসে আয়কর হিসেবে ২৫ হাজার টাকা কেটে রেখে জাফর সাহেব ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছেন। সুতরাং ৫ লাখ টাকা আয়ের ওপর ২৫ হাজার টাকার অতিরিক্ত আর কোনো আয়কর দিতে হবে না।
সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্নের সঙ্গে কিছু নথি জমা দিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের ফটোকপি বা প্রমাণপত্র (সার্টিফিকেট) এবং সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর, প্রাপ্ত সুদ ও উৎসে আয়কর কেটে রাখার প্রমাণপত্র। সঞ্চয়পত্রের ‘সুদ’ আয়কর রিটার্নে আর্থিক পরিসম্পদ থেকে আয়ের কলামে দেখাতে হবে। আর সম্পদ বিবরণীতে ইনভেস্টমেন্ট কলামে সঞ্চয়পত্রের ক্রয়মূল্য দেখাতে হবে।
এফডিআর ও মেয়াদি আমানতে যা করবেন
আয়কর নথিতে স্থায়ী আমানত (এফডিআর)-সংক্রান্ত বিষয়ে বেশ কিছু মিশ্র ধারণা রয়েছে। অনেকেই বিনিয়োগ হিসেবে এফডিআরকে বিবেচনা করেন। আবার সম্পদ বিবরণীতে দেখালেও প্রতিবছরের সুদ বা মুনাফা হিসাবভুক্ত করেন না। নিয়ম অনুসারে, প্রতিবছর সঞ্চয়ী ব্যাংক হিসাবের বিবরণীর মতো এফডিআরের বিবরণীও নথিতে তুলতে হবে।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, যে বছর স্থায়ী আমানত বা এফডিআর খোলা হবে, সেই বছরই সম্পদ বিবরণীতে দেখাতে হবে। স্থায়ী আমানতের সুদ বা মুনাফা প্রতিবছর উত্তোলন করা যায়। এই সুদ বা মুনাফা আয়কর নথিতে আর্থিক পরিসম্পদ থেকে আসা আয় হিসেবে দেখাতে হবে।
কিছু কিছু স্থায়ী আমানত মেয়াদ শেষে সুদ প্রদান করে থাকে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে সঠিক তথ্য আনতে হবে। মেয়াদ শেষে মুনাফা প্রদান করলে যে বছর মেয়াদে উত্তীর্ণ হবে, সংশ্লিষ্ট কর বছরে এনক্যাশমেন্ট সার্টিফিকেট গ্রহণ করে তা আয়কর নথিতে যথাযথভাবে দেখাতে হবে। স্থায়ী আমানতের সুদ ন্যূনতম কর হিসেবে গণ্য হবে।
ডিপিএসে যা লক্ষ রাখবেন
মাসিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা রাখাকেই ডিপিএস বলে। ডিপিএসের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যাংকগুলো মাসিক, ত্রৈমাসিক বা ছয় মাস অন্তর কিংবা বাৎসরিক ভিত্তিতে সুদ বা মুনাফা প্রদান করে। কিছু ব্যাংক সুদ বা মুনাফার ওপর উৎসে আয়কর কেটে রাখে। আবার কিছু ব্যাংক প্রতিবছর সুদ বা মুনাফা দেয়, কিন্তু উৎসে আয়কর কেটে না রেখে মেয়াদ শেষে ডিপিএস ভাঙানোর সময় উৎসে আয়কর কেটে রাখে।
এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে। এক. ডিপিএসে বাৎসরিক ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ সুবিধা পাওয়া যাবে। দুই. ডিপিএসের ক্ষেত্রে ব্যাংক যদি প্রতিবছর মুনাফা বা সুদের ওপর উৎসে আয়কর কেটে রাখে, তাহলে (গ্রস) সুদ বা মুনাফা অন্যান্য উৎসে আয় হিসাবে দেখাতে হবে এবং বছর শেষে স্থিতি সম্পদ বিবরণীতে তা উল্লেখ করতে হবে।
তিন. আবার এমন হতে পারে যে মুনাফা ব্যাংক বিবরণীতে যুক্ত হচ্ছে, কিন্তু ব্যাংক উৎসে আয়কর কেটে রাখছে না। এ ক্ষেত্রে শুধু সম্পদ বিবরণীতে যে পরিমাণ টাকা জমা দেখানো হচ্ছে, সে পরিমাণ টাকা সম্পদ বিবরণীতে আগের বছর জমা দেখানো থাকলে, তার সঙ্গে যোগ করে এ বছর দেখাতে হবে। যে বছর ডিপিএসের মেয়াদ পূর্তি বা ভাঙানো হবে, সে বছর পুঞ্জীভূত মুনাফা অন্যান্য উৎসের আয় হিসাবে দেখাতে হবে।
চার. ডিপিএসের ক্ষেত্রে প্রতিবছরের ব্যাংক বিবরণী নিতে হবে এবং ডিপিএস ভাঙানোর সময় সার্টিফিকেট নিতে ভুল করা যাবে না।
পাঁচ. ডিপোজিট পেনশন স্কিমের (ডিপিএস) সুদ ন্যূনতম কর হিসেবে গণ্য হবে।
তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে
ব্যাংকে যেসব লেনদেন হবে, তা অবশ্যই আপনার আয়কর নথিতে প্রদর্শিত আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। অন্য কোনো ধরনের লেনদেন হলে, তার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা থাকতে হবে। মোট বা গ্রস ব্যাংক সুদ বা মুনাফা আর্থিক পরিসম্পদ খাতে আয় হিসাবে দেখাতে হবে। উৎসে কর আপনার প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয় হবে।
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে
সিটি করপোরেশনের মধ্যে যাঁদের গৃহ সম্পত্তি নেই ও কোনো ধরনের বিনিয়োগ করেননি এবং যাঁদের মোট পরিসম্পদ ৪০ লাখ টাকার কম, তাঁরা এক পাতার ফরম ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যরা সুবিধাজনক ফরম ব্যবহার করবেন, অথবা অনলাইনে আয়কর জমা দিতে পারবেন।
আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২৩ ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার কথা। পুরোনো আইনে করদাতার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপকর কমিশনার ২ মাস এবং যুগ্ম কর কমিশনার ২ মাস করে মোট ৪ মাস সময় দিতে পারতেন। নতুন আইনে এখন আর সে সময় পাওয়া যাবে না। তবে আয়কর রিটার্ন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে জমা দেওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে গুনতে হবে ৪ শতাংশ হারে মাসিক জরিমানা। পাশাপাশি কর অবকাশ, হ্রাসকৃত কর হার, রিবেট ও কর অব্যাহতি কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না। ফলে কর দিবসের পরে আয়কর রিটার্ন দিলে আয়কর কয়েক গুণ বেশি দিতে হবে।
লেখক: আয়কর আইনজীবী ও নির্বাহী পরিচালক, গোল্ডেন বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :