দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে পাশের গ্রামে। সে কী চিৎকার। আজও কান থেকে সেই শব্দ দূর হয়নি। তারপরে হলো কী— আমাদের গ্রামের দিকে আসার আগেই যেনো পালিয়ে যাই, সেই পরামর্শ করে বেরিয়ে পড়ি। পেটে পাঁচ মাসের সন্তান আর একটা পোটলা। পোটলায় কিছু সোনার গয়না। ভাই ছিল সঙ্গে, তার হাতে আরেকটা ব্যাগ। এই নিয়ে চলে এলাম এপারে। এই দেশে ঢোকার পরেও মনে হচ্ছিল— এখানেও চলে আসবে সন্ত্রাসীরা! এরপর পাঁচ বছর কেটে গেলো। এখনও ঘুমের মধ্যে চমকে উঠি। এখনও মনে হয়, প্রাণের কোনও দাম নেই— কথাগুলো বলছিলেন উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প-৯ এর এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি কথা বলতেও রাজি হচ্ছিলেন না। নাম পরিচয় কোথাও উল্লেখ হবে না বলার পরে একে একে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া কথাগুলো বলতে থাকেন তিনি। এক পর্যায়ে ঝরঝর করে কেঁদে বলেন, এদেশে আসার পরে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। এখন ত্রাণের জিনিস দিয়ে চলি। সন্তানের কথা ভেবে কষ্ট হয়। সে জানলো না জীবন কত সুন্দর হতে পারতো।
ক্যাম্প ৮-ই এর এক নারী বলেন, আমিতো এখনও একটু জোরে কথা বললে হিসু করে দিই। শরীর কেঁপে জ্বর আসে। আমার এখানে দুই সন্তান আছে, স্বামী বিছানাগত। এখানকার সরকার খেতে দেয়, পরতে দেয়, কম্বল দেয়, ঘর দেয়। কিন্তু কেউতো জিজ্ঞেস করলো না— আমার ওখানে কী ছিল? কেউ তো জিজ্ঞেস করে না— আমি এখানে থাকতে চাই কিনা। আমি আমার সেই ঘরে ফিরতে চাই, যেখানে আমি বলতে পারতাম— এইটা আমার ঘর, এই জমি আমার।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, শিবিরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিশু যোগ হচ্ছে। ইউএনএইচসিআরের হিসাবে, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী ৯ লাখ ২৩ হাজার ১৭৯ জন নিবন্ধিত রয়েছেন। এর মধ্য ৪ লাখ ৭০ হাজার ৮২২ জন শিশু। অর্থাৎ রোহিঙ্গা শিবিরের ৫১ শতাংশই শিশু। সরেজমিনে তিন ক্যাম্পের মধ্যে ক্যাম্প ৮-ই তে মেয়েশিশু ২ হাজার ১৬০, ছেলেশিশু সংখ্যা ২হাজার ২৫৯টি। ৮-ডব্লিউ ক্যাম্পে মেয়েশিশু ২ হাজার ২৮০, ছেলেশিশু সংখ্যা ২ হাজার ৪২৭টি এবং ক্যাম্প-৯ এ মেয়েশিশু ২ হাজার ৩৮৬ ও মেয়েশিশু সংখ্যা ২ হাজার ৪৫২টি।
সরাসরি মানসিক সমস্যা বা ডিপ্রেশন বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত না হলেও মানসিক যন্ত্রণার সঙ্গে সম্পর্কিত রোহিঙ্গা কিছু পরিভাষা আছে, সেসব দিয়েই তারা পরিস্থিতির বর্ণনা করেন। তারা নিজের পরিস্থিতি বুঝাতে সেসব শব্দই ব্যবহার করে থাকেন। তারা সাধারণত মানসিকভাবে ঠিক না থাকাকে ‘ওয়াশান্তি’ (অশান্তি), ‘অস্থির’ বা ‘মনে শান্তি নেই’ এসব মনে করে থাকে। ডিপ্রেশন শব্দটা শুনেছেন কিনা বা এটা কী তা বুঝেন কিনা, প্রশ্নে কুতুপালং মেইন ক্যাম্পের এক নারী বলেন, ‘‘একবার এক এনজিও এসে বলেছিল ‘মেন্টাল হেলথ’ এর কথা। তারাই কথা বলার সময়ে বলেছিল— নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখলে, কাজকর্মে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে, একা মনে হলে, কোনও কাজের যোগ্য না মনে হতে থাকলে, যে মানসিক পরিস্থিতি হয়— সেটাই এটা (ডিপ্রেশন)। এরকম হলে সেন্টারে (হেলথ ক্লিনিক) জানাতে বলেছে।’’
ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল হিউম্যানিট্যারিয়ান অর্গানাইজেশন এমএসএফ ক্যাম্পের নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে গভীরভাবে কাজ করছে। মানসিক ইস্যু নিয়ে ক্যাম্পে কাজ করতে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় প্রশ্নে তারা বলছে— মানসিক অসুস্থতা এক ধরনের অশুভ আত্মা দ্বারা আবিষ্ট। ধর্মীয় নেতাদের স্থানীয় চিকিৎসা পদ্ধতি ছাড়া এটার কোনও চিকিৎসা বা এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার সুযোগ নেই এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই এই পদ্ধতিই অবলম্বন করেন। তাদের সাংস্কৃতিক বিশ্বাস, রীতি, সমাজ ব্যবস্থার কারণে ক্যাম্পে নারীদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সংবেদনশীল ও কঠিন। বিশেষত কিশোরী ও তরুণী মেয়েদের ক্ষেত্রে খুবই চ্যালেঞ্জিং। নারীরা তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সামনে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের যন্ত্রণার কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন। এছাড়া ক্যাম্পে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য আড়াল বা গোপন স্থান নেই। আবার মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি বড় ধরনের ভীতিও আছে, যা নারীদের ভোগান্তির সময় কোনোরকম সাহায্য চাইতে বাধা দেয়।
এই প্রতিবেদনের জন্য যে ফোকাস গ্রুপ তৈরি করা হয়, তার ১৫ জন নারীর মধ্যে একজন ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের একজন বালুখালী ক্যাম্পে আলাপকালে জানান, তাকে এখনও প্রায় সারা রাত জেগে থাকতে হয়। এ কারণে তাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বেশকিছু ওষুধও খেতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সামরিক (মিয়ানমার) বাহিনী আমার বাবার কাঁধ ভেঙে দেয়। পালাতে গিয়ে আমি সারা শরীরে আঘাত পাই। সেই ব্যথা আমি এখনও অনুভব করি। বিষণ্ন লাগে আমার ঘর আমার জমি আমার এলাকার কথা মনে করে। ক্যাম্পের উঁচু জায়গায় গিয়ে আমি মিয়ানমারের দিকে চেয়ে থাকি। যদি কোনোদিন যেতে পারতাম। আমার রক্তচাপ বেশি। আমি এখনও স্পষ্ট গুলির আওয়াজ পাই।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আপনার মতামত লিখুন :