বিভিন্ন ছাড় দিয়ে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়াল করার সুযোগ দিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে নানা ছাড়ের পরও খেলাপি ঋণ বেড়ে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। ঋণ চাহিদা কমার পরও প্রতিদিন কিছু ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং মুদ্রাবাজার থেকে বড় অঙ্কের ধার করতে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বছরের পর বছর নীতি শিথিলতায় ব্যাংক খাতের দুর্দশা বেড়েছে। আর্থিক খাতের বেশির ভাগ সূচকের অবনতি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক খাতের সুস্থতা বোঝার সবচেয়ে বড় সূচক খেলাপি ঋণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর বিভিন্ন উপায় বের করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যেও চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি ঋণ ৩৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়ে গত জুন শেষে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা হয়েছে। মোট ঋণের যা ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ যতটুকু, প্রকৃত অবস্থা তার চেয়ে আরও খারাপ।
আইএমএফের শর্ত মেনে অবলোপন ও পুনঃতপশিলের পর আদায় না হওয়া ঋণকেও দুর্দশাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে। ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা মোট ঋণের ২৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ ছিল দুর্দশাগ্রস্ত। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে পুনঃতপশিল হয়েছে ১৪ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। নতুন করে পুনঃতপশিল হওয়া ঋণ বিবেচনায় না নিলেও ব্যাংক খাতে চাপে থাকা ঋণ এখন ৪ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত অবলোপন ও পুনঃতপশিলের পর আদায় না হওয়া ঋণস্থিতি ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সর্বশেষ ২০২২ সালভিত্তিক প্রতিবেদনে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ দেখানো হয় ২৫ শতাংশের বেশি। এর পর চলতি বছর আরও ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ছাড় না থাকলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়ত। ঋণের টাকা ফেরত না এলে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারায়। আবার প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়, সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়। এর ফলে মূলধন ঘাটতি বেড়ে যায়। বছর দুয়েক আগেও বেশির ভাগ ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল। এখন তাতে ভাটা পড়েছে। এর একটি বড় কারণ ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে আসছে। আবার আস্থাহীনতার কারণে আমানত প্রবৃদ্ধি কমছে।
ব্যাংকাররা জানান, ঋণ পরিশোধে ঢালাও শিথিলতা এবং ব্যাপক ছাড় ব্যাংক খাতকে দুর্দশায় ফেলেছে। একসময় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে সর্বোচ্চ ৩৬ মাসের জন্য পুনঃতপশিল করা যেত। তবে গত বছর মাত্র আড়াই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে একটি ঋণ চার দফায় সর্বোচ্চ ২৯ বছরের জন্য পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এর পর গত বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙে ৬৩ হাজার ৭২০ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতপশিল হয়েছে। অবশ্য বিশেষ বিবেচনায় পুনঃতপশিলের সংস্কৃতি শুরু হয় ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর মাত্র ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পুনঃতপশিলের সুযোগ দেওয়া হয়। এর পরের বছর ৫০০ কোটি টাকার বড় ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়।
২০১৮ সালে আবার ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ১২ বছরের জন্য পুনঃতপশিল করা হয়। এ রকম বিশেষ সুবিধার মধ্যে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও কাউকে আর খেলাপি করা হয়নি। পরের বছর যে পরিমাণ কিস্তি দেওয়ার কথা, কেউ ১৫ শতাংশ দিলে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ পেয়েছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালে কিস্তির অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো যাচ্ছে। এভাবে ব্যাংক খাতের আসল চিত্র আড়ালে আছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতের পীড়িত বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ ঊর্ধ্বমুখী। প্রভিশন সংরক্ষণের হারও কম। গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের মাত্র ৫৮ শতাংশের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়েছে। মূলধন পর্যাপ্ততার অনুপাত কমেছে। নিয়মকানুন শিথিল এবং দুর্বল তদারকির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির বিপরীতে বড় অঙ্কের টাকা উঠে আসা, আমানতে নিম্ন প্রবৃদ্ধি, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কমে যাওয়া এবং বিভিন্ন ব্যাংকে প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগের ফলে অনেক ব্যাংকে আমানত কমেছে। এসব ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে আগামীতে আর্থিক খাতের দুর্বল পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে এবং তারল্যের ওপর চাপ আরও বাড়তে পারে। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ কমাতে এবং কিছু ব্যাংকের মূলধন সংকট দূর করতে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন এবং করপোরেট সুশাসন জোরদারের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য আর্থিক খাতের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা জরুরি বলে মত দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক খাতের এখনকার বড় সমস্যা বেনামি ও ভুয়া ঋণ এবং অর্থ পাচার। এসবের প্রভাবে অর্থ প্রবাহ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব জানলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। পরিদর্শনে গিয়ে কেউ অনিয়ম ধরলে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো তাঁকে চাপে পড়তে হচ্ছে। অথচ এক সময় যেসব কর্মকর্তা বড় অনিয়ম ধরতেন, তাদের স্বর্ণপদকসহ বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হতো।
ব্যাংকাররা জানান, পরপর সুবিধার কারণে এখন ব্যাংক খাতে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির নতুন একটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। যারা টাকা থাকলেও পরিশোধ না করে অন্য কাজে খাটাচ্ছে। কিছু বললেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি-সহায়তার দোহাই দিচ্ছে। এরা নতুন নতুন আরও কী কী সুবিধা নেওয়া যায়, তা নিয়েই বেশি উৎসাহিত থাকে। অবশ্য ডলার সংকট, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈশ্বিক সংকটের কারণেও অনেকে টাকা দিতে পারছে না।
বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি একটি শ্রেণি সব সময় থাকে। যারা মনে করে, ঋণ জমতে থাকুক, বড় একটা ছাড় নিয়ে তখন বেরিয়ে যাবে। তবে এর বাইরে প্রকৃত সমস্যার কারণেও অনেকে ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এখন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এতে করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে এ রকম ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ব্যাংকগুলো এলসি দিতে না পারায় অনেকে সংকটে পড়ে টাকা ফেরত দিতে পারছে না। যে কারণে পুনঃতপশিলের পরও অনেক ঋণ আর আদায় হচ্ছে না।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি-বেসরকারি খাতের ১৩টি ব্যাংকের ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রভিশন সংরক্ষণে বাড়তি সময় বা ডেফারেল সুবিধা দিয়েছে। বিপুল অঙ্কের এ অর্থ বাদ দিয়েই গত জুন পর্যন্ত পুরো ব্যাংক খাতে প্রভিশন রাখার কথা ছিল ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে রাখতে পেরেছে মাত্র ৭৯ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। এর মানে ঘাটতি ছিল ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতির তথ্য আড়ালের ফলে মূলধন ঘাটতির আসল চিত্র সামনে আসেনি। এর পরও গত জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের ১৫টি ব্যাংকে ৩৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানান, ঋণ চাহিদা কমলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়ে। তবে এখন একদিকে ডলার বিক্রির বিপরীতে টাকা চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে, অন্যদিকে বিভিন্ন নীতি-সহায়তার কারণে ঋণ ফেরত আসছে কম। নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিতরণ হওয়া ঋণের বেশির ভাগই আটকে আছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় অর্থ প্রবাহ কমেছে। যে কারণে বেসরকারি খাতে আগস্ট পর্যন্ত ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ১০ শতাংশের নিচে নেমেছে। আবার সরকার গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, পরিশোধ করেছে তার চেয়ে ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা বেশি। এর পরও সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো গত রোববার ২০ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা ধার করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেয় ১৪ হাজার ১৫ কোটি টাকা। কলমানিসহ আন্তঃব্যাংক থেকে নেওয়া হয় ৬ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদে এ লেনদেন হয়। এভাবে ধারের পরও কিছু ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যর্থতার তালিকায় এমন ব্যাংক রয়েছে, যারা এক সময় অন্য ব্যাংকে ধার দিত।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এমনিতেই অনেক ক্ষেত্রে ঋণের টাকা আদায় করা কঠিন। আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা বলে ব্যাংকগুলো ঋণ আদায় জোরদার করত। তবে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক শিথিল হওয়ায় অনেক গ্রাহক ব্যাংক কর্মকর্তাদের পাত্তা দিচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য সবার আগে দরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা। তবে এখন ঘটছে উল্টোটা। প্রভাবশালীরা ইচ্ছামতো নীতি প্রণয়ন এমনকি আইন সংশোধন করিয়ে নিচ্ছেন। সর্বশেষ ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন এর বড় উদাহরণ। আবার পরিচালক পদে ৯ বছরের পরিবর্তে টানা ১২ বছর থাকার সুযোগসহ বিভিন্ন শিথিলতা দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দিচ্ছে, তা প্রকৃত তথ্য নয়। মামলার কারণে অনেক ঋণকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। আবার অবলোপন করা ঋণও খেলাপির হিসাবে দেখানো হয় না। এসব বিবেচনায় নিলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি।
তিনি আরও বলেন, প্রাক্তন দুই প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীন আহমদ ও মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৯৮ ও ১৯৯৯ সালে ঋণখেলাপিদের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই তা কার্যকর করেনি। লাগামহীন ঘোড়া থামাতে হলে ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দের পাশাপাশি তাদের জেলের ভাত খাওয়াতে হবে। এতে হয়তো অবস্থার উন্নতি হতে পারে।
সূত্র: সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :