পাসপোর্ট এনআইডিসহ ১৯ কাজের অতি প্রয়োজনীয় জন্মসনদ এখন ‘সোনার হরিণ’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩, ১২:৪৪ পিএম

পাসপোর্ট এনআইডিসহ ১৯ কাজের অতি প্রয়োজনীয় জন্মসনদ এখন ‘সোনার হরিণ’

স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র– এ রকম ১৯ কাজে প্রয়োজন পড়ছে জন্মসনদের। এই জন্মসনদ এখন ‘সোনার হরিণ’। একজন নাগরিকের এমন গুরুত্বপূর্ণ দলিল নিবন্ধন নিয়ে রীতিমতো চলছে ছেলেখেলা। মাস চারেক হয়ে গেল জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম অনেকটাই অকার্যকর। সার্ভার জটিলতায় বেশির ভাগ মানুষ ঢুকতে পারছেন না স্থানীয় সরকার বিভাগের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে। নানা কসরত করে ঢোকা গেলেও ডেটা এন্ট্রি দেওয়ার আগেই সার্ভার বিগড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মহাসংকটে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

আর কিছুদিন বাদেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণিতে শুরু হবে ভর্তি কার্যক্রম। প্রতিবছর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৩৫ লাখ শিশু। এ ছাড়া অনেক শিশু প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতেও ভর্তি হয়। স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এ জন্য আগেভাগেই অভিভাবকরা সন্তানের জন্মসনদ সংগ্রহ করেন। জন্মসনদ নিবন্ধনের গোলমেলে পরিস্থিতিতে লাখ লাখ শিশুর অভিভাবক আছেন উৎকণ্ঠায়। স্কুলে ভর্তি ছাড়াও যাদের নানা কারণে জন্মসনদ প্রয়োজন, তারাও আছেন গভীর সংকটে। কয়েক বছরের হিসাব ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রতিবছর ৩২ থেকে ৩৬ লাখ জন্মসনদ নিবন্ধন হয়। এর মধ্যে ২০ লাখই হয় বছরের শেষ তিন মাসে। সে হিসাবে এই ২০ লাখ মানুষের এখন ঘুম হারাম! সম্প্রতি জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভারটি হ্যাক হলে পাঁচ কোটি মানুষের তথ্য চুরি হয়ে যায়। এর পর থেকে সার্ভারের অবস্থা আরও নাজুক। এ সুযোগে দেশের প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে গড়ে উঠেছে দালাল চক্র। যারা দালালদের খুশি করতে পারছেন, তাদের হাতে উঠছে জন্মসনদ। অন্য সেবাগ্রহীতারা পড়ে থাকছেন হয়রানির বৃত্তে। ২০২১ সালে সার্ভার থেকে সাত কোটি মানুষের জন্মনিবন্ধনের তথ্য গায়েব হয়ে যায়। নতুন করে নিবন্ধন করতে গিয়ে সেসব মানুষকে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা প্রশাসনের প্রায় ছয় হাজার আইডি থেকে জন্মনিবন্ধন করা যায়। সার্ভার দুর্বল থাকায় ওই আইডি থেকেও ডেটা এন্ট্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।

রাজধানীতে প্রায় বন্ধ জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন

একটি জন্মনিবন্ধন সনদ ইস্যু করতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রায় ১০০ টাকা খরচ হয়। তবে ৪৫ দিনের মধ্যে যাদের বয়স, তাদের দেওয়া হয় বিনামূল্যে; ৫ বছর বয়স পর্যন্ত ২৫ টাকা ও ৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের জন্য ৫০ টাকা ফি নেওয়ার বিধান রয়েছে। এ টাকা সরাসরি চলে যায় সরকারের তহবিলে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের সুনামের বদলে বাড়ে দুর্নাম। এ জন্য ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের জন্মসনদ ইস্যুতে দীর্ঘদিনের অনীহা। চার মাস আগে জন্মনিবন্ধন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ডিএসসিসি। সম্প্রতি এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এই ফি সিটি করপোরেশনের কোষাগারে যাবে। পাশাপাশি ৪৫ দিনের বেশি যাদের বয়স, তাদের ক্ষেত্রে আরও ৩০ টাকা সার্ভিস চার্জ বেশি নেবে সিটি করপোরেশন। এ প্রস্তাবে সিটি করপোরেশন সেবা দিতে রাজি হয়। তবে সার্ভার জটিলতায় তারাও সেবা দিতে পারছে না। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির সমকালকে জানান, এ সেবা যাতে দ্রুত চালু করা যায়, সে জন্য তারা সোমবারও সভা করেছেন। আশা করা যায়, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সেবা চালু করা যাবে।

এদিকে, এ প্রক্রিয়া সহজ করতে গত ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ওপর জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের দায়িত্ব দেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তবে এই সেবা দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি কিংবা জনবল কাউন্সিলর কার্যালয়ে নেই। ডিএনসিসির ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের (আগারগাঁও-তালতলা) কাউন্সিলর ফোরকান হোসেন বলেন, ‘আমরা সার্ভারেই তো ঢুকতে পারছি না। একটা পর্যায়ে ওটিপি আসে। পরে সাবমিট করতে গেলে আর হয় না। কম্পিউটার-প্রিন্টারও কর্তৃপক্ষ দেয়নি। এ জন্য আমরা সেবা দিতে পারছি না।’

গত সোমবার ফার্মগেটের ৪/এ, ইন্দিরা রোডের মাহাবুব প্লাজার চতুর্থ তলায় ডিএনসিসির ২৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরানের কাছে মানুষের জটলা। এ ভিড় জন্ম কিংবা মৃত্যুসনদের জন্য। তবে সার্ভারে ঢুকতে পারছেন না ওয়ার্ড সচিব দবির আলী লস্কর। তিনি কম্পিউটার দেখিয়ে বলেন, ‘দুই ঘণ্টা ধরে সার্ভারে ঢোকার চেষ্টা করছি, কোনোভাবেই পারছি না। একটি নিবন্ধনের ডেটা এন্ট্রি শেষ পর্যায়ে থাকলেও প্রিন্ট হওয়ার আগেই সার্ভার চলে গেল। অনেক সময় আমরা অফিস সময়ের পরও কাজ করি। যখন সার্ভার আসে, তখন ডেটা এন্ট্রি দেওয়ার চেষ্টা করি।’

পারভেজ আহমেদ নামে একজন জানান, তিন দিন চেষ্টা করেও ছেলের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে পারেননি। তাই কাউন্সিলর কার্যালয়ে খোঁজ নিতে এসেছেন। তারাও অসহায়।

২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান বলেন, ‘দিন ১৫ হলো জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের সার্ভারের পাসওয়ার্ড পেয়েছি। তবে এটি পেয়ে ঝামেলা আরও বেড়েছে। ১৫ দিনে মাত্র তিনটি নিবন্ধন করা গেছে। এর মধ্যে একজনের অনলাইনে টাকা জমা দেওয়া ছিল না। তাই তাঁর নিবন্ধন কপি দেওয়া যায়নি। এই কাজের জন্য প্রতিদিন অনেকে অফিস ও বাসায় আসেন। অনেকে ফোন দেন। সাধারণ মানুষের এ ভোগান্তিতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে।’

ডিএনসিসির ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের (ফার্মগেটের পাশের তেজকুনীপাড়া) কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের জন্য কম্পিউটার প্রিন্টারসহ প্রয়োজনীয় আসবাব নেই। নিবন্ধনের জন্য আইডি-পাসওয়ার্ডও বুঝে পাননি বলে জানান কাউন্সিলর শামীম হাসান। তিনি বলেন, ‘ওয়ার্ড সচিব ছাড়া কার্যালয়ে কোনো জনবল নেই। ওয়ার্ড সচিব কোনো কাজে গেলে দপ্তর ফাঁকা থাকে। এ ছাড়া আমারও সব সময় কার্যালয়ে বসে থাকা সম্ভব নয়। সাধারণ নাগরিকরা জরুরি প্রয়োজনে এলে তাদের সেবা দেবে কে? জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম ওয়ার্ড পর্যায়ে দেওয়ার সময়ই বিরোধিতা করেছিলাম।’

ডিএনসিসির ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে (তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল) গিয়ে জানা যায়, ডিসেম্বরের পর থেকে এ দপ্তরের সচিবের পদ শূন্য। খন্দকার জাসুর বদলির পর আবুল কালাম আজাদ, আবু সালেহ ও উত্তম দত্ত নামে তিনজনকে পদায়ন করা হলেও কেউ থাকতে চাননি। তদবির করে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ফলে ওই ওয়ার্ডে পুরো কাজই বন্ধ। এ ব্যাপারে ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারোয়ার বলেন, ‘ওয়ার্ড কার্যালয়গুলোতে আগে থেকেই কম্পিউটার আছে। সেই কম্পিউটারে ওয়ার্ড কার্যালয়ের সচিব কাজটি করবেন। তবে প্রথম প্রথম একটি বিষয় চালু হলে কিছু সমস্যা তো থাকেই। ধীরে ধীরে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

ঢাকার বাইরে সার্ভারের ইঁদুর-বিড়াল খেলা

বগুড়া শহরের ঝোপগাড়ি এলাকার বাসিন্দা কোহিনূর বেগম বলেন, মেয়ের হার্টের চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে হবে। তার পাসপোর্ট করতে জন্মনিবন্ধন লাগবে। পৌরসভায় পাঁচ দিন ধরে ঘুরেও কাজ হচ্ছে না। বগুড়া পৌরসভার জন্মনিবন্ধনের ডেটা এন্ট্রির দায়িত্ব পালনকারী ফৌজিয়া ইসলাম বলেন, আড়াই মাস ধরে জাতীয় সার্ভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগেও সার্ভারে সমস্যা ছিল। দিনে ১০টির বেশি আবেদন কখনোই করা সম্ভব হয়নি।

কয়েক মাস ঘুরেও মেয়ের এবং নিজের জন্মসনদ হাতে পাননি রংপুর নগরীর পূর্ব শালবন শান্তিনগর এলাকার মাসুদ রানা সাকিল। তিনি বলেন, এখানে অদক্ষ জনবলের পাশাপাশি কিছু দালাল প্রকৃতির লোক রয়েছে, যাদের কারণে দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দেওয়ানবাজারের শুভ্র দীপ ধর বলেন, ‘সন্তানের জন্মসনদের জন্য এসেছিলাম এক সপ্তাহ আগে। তখন বলা হলো, মা-বাবার জন্মসনদ লাগবে। এর পর থেকে প্রতিদিন আসছি। সার্ভারের সমস্যার কথা বলে ফিরিয়ে দিচ্ছে।’

সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীটুলা এলাকার মোহাম্মদ আলীম উদ্দিন বলেন, ‘আমার সন্তানের বিদেশযাত্রা উপলক্ষে জন্মসনদ প্রয়োজন। করপোরেশনে বারবার গিয়ে শুধু সার্ভারের সমস্যার কথা শুনতে হচ্ছে।’

যা বলছেন প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা

সার্ভার দুর্বল হওয়ার কারণ সম্পর্কে প্রযুক্তি বিশ্লেষক সুমন আহমেদ সাবির সমকালকে বলেন, এ সার্ভার তৈরি করেছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। একটি সার্ভার বন্ধ থাকলে বিকল্প কী উপায়ে কাজটি চলবে, তারা সেই উপায় রাখেনি। আর সার্ভারের কারিগরি সমস্যা থাকলে এক-দু’দিন থাকতে পারে; বছরের পর বছর এটা চলতে পারে না। প্রযুক্তি বিশ্লেষক রাশেদ মেহেদী বলেন, এখানে দুর্নীতি না থাকলে সার্ভারের অবস্থা এমন হওয়ার কারণ নেই। জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন সার্ভারটি আপ টু দ্য মার্ক না। যে হোস্টিং নেওয়া হচ্ছে, সেটি মানসম্মত নয়। হোস্টিং ব্যবস্থাপনা দুর্বল। আনলিমিটেড স্টোরেজ নেই। ব্যান্ডউইথ দুর্বল। প্রয়োজনীয় ব্যাকআপ নেই। সার্ভারের নিরাপত্তা নেই। যে কারণে এই সার্ভার থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষের তথ্য চুরি হয়ে গেছে।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান। তিনি বলেন, সার্ভার ঠিক আছে। কোনো তথ্যও চুরি হয়নি। সার্ভারও ডাউন না। সিটি করপোরেশন-পৌরসভাগুলো কেন জন্মসনদ ইস্যু করতে পারছে না, সেটা তারা ভালো জানবেন।

মৃত্যুসনদ নিতে আরও বড় ঝক্কি

মৃত্যুসনদ নিতে গেলে জন্মনিবন্ধনের বাধ্যবাধকতার কারণেও নাগরিকদের পড়তে হচ্ছে গ্যাঁড়াকলে। ময়মনসিংহ নগরীর বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তাঁর এক নিকটাত্মীয় সম্প্রতি মারা যান। সিটি করপোরেশনে যান মৃত্যুসনদ আনতে। তখন বলা হয়, জন্মসনদ লাগবে। জন্মসনদ নিতে গেলে বলা হয়, এটা সার্ভারে নেই। নতুন করে জন্মসনদ করতে হবে। এ জন্য তাঁকে ১৫ দিন দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।

ময়মনসিংহ নগরীর সানকিপাড়া শেষ মোড় এলাকার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা ফারজানা শারমিন তপি গত ২৫ আগস্ট ডেঙ্গুতে মারা যান। তাঁর মৃত্যুনিবন্ধন সনদ পাওয়ার জন্য গত ১০ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশনে গেলে তাঁর আত্মীয়কে জানানো হয়, সার্ভারে তাঁর জন্মনিবন্ধন সনদ নেই। অথচ ২০০৭ সালেই তপির জন্মনিবন্ধন করা ছিল। সেটা দেখালে বলা হয়, নতুন করে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। এই কাজ করতেও অন্তত ১০ দিন ঘুরতে হয় বলে জানান তাঁর স্বজন।

স্থানীয় সরকার সচিবের ভাষ্য

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, জন্মনিবন্ধন ও সার্ভার নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিষয়টির সমাধানও হয়ে গেছে। এখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না। সিটি করপোরেশনসহ সবাই সহজেই জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন করতে পারবেন। সূত্র: সমকাল

গো নিউজ২৪

Link copied!