এক ব্যাংক পরিচালকের ২২৫ ভুয়া এফডিআর

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২৩, ০৭:০৯ পিএম

এক ব্যাংক পরিচালকের ২২৫ ভুয়া এফডিআর

কাদের, সুজন, জাহিদ বা মীর তানজিল– এ রকম বিভিন্ন নামে খোলা হয়েছে স্থায়ী আমানত বা এফডিআর। অপ্রদর্শিত আয়ের তথ্য গোপন করতে ব্যাংকটির বিজয়নগর শাখায় অন্তত ২২৫টি ভুয়া এফডিআরের সন্ধান পেয়েছে বিএফআইইউ। সব এফডিআর ফরমে গ্রাহকের ব্যক্তিগত ও নমিনি-সংক্রান্ত তথ্যের ঘর ফাঁকা; দেওয়া হয়নি জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি। অর্থের উৎস বিষয়েও কিছু বলা নেই। ভিন্ন ভিন্ন নামে এফডিআর হলেও সব ফরমে একই সই এবং অভিন্ন মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। বেনামি এসব এফডিআরের আসল সুবিধাভোগী সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স (এসবিএসি) ব্যাংকের পরিচালক ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নেওয়াজ।

২০২০ সাল থেকে ব্যাংকের বিজয়নগর শাখাকে ব্যবহার করে তিনি এ রকম হিসাব পরিচালনা করে এলেও এত দিন তা আড়ালে ছিল। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) গত জানুয়ারি মাসের এক তদন্তে প্রথমে এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। বিএফআইইউ প্রাথমিকভাবে ২২৫টি বেনামি এফডিআর চিহ্নিত করলেও প্রকৃত হিসাব আরও অনেক বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। টাকা জমা, উত্তোলন– সবই হয়েছে সন্ধ্যার পর। শাখাটির ব্যবস্থাপক মো. ইসলামুল হক এবং হিসাব পর্যালোচনাকারী ও নিশ্চিতকারী কর্মকর্তা খন্দকার নূরে ইমাম বেনামি এসব হিসাব খুলতে সহায়তা করেন।

এ ঘটনায় ১৬ লাখ টাকা জরিমানা করে তা আদায় করেছে বিএফআইইউ। মোহাম্মদ নেওয়াজকে ব্যক্তিগতভাবে ৫ লাখ, ব্যাংককে ১০ লাখ এবং শাখা ব্যবস্থাপককে ব্যক্তিগতভাবে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি চেকের বিপরীতে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন নেওয়াজ। এরপর ২৮ মার্চ আবার বিএফআইইউর সিদ্ধান্তের স্থগিতাদেশ চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আগামী ২৫ এপ্রিল রিটের শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত। জানা গেছে, বিএফআইইউর সিদ্ধান্ত মেনে জরিমানার অর্থ পরিশোধের পর  আবার রিট করা নিয়ে ব্যাংকের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সোমবার ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েকজন পরিচালক এ বিষয়ে জরুরি একটি বৈঠক করেন। সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য মোহাম্মদ নেওয়াজের ব্যক্তিগত টেলিফোন নম্বরে ফোন করে পাওয়া যায়নি।

এসবিএসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লা বলেন, মোহাম্মদ নেওয়াজ একটি ‘পাগলামি’ করে বসেছেন। তবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কোনো পরিচালকের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানানো হয়। এ ক্ষেত্রেও তা করা হয়েছে। বিএফআইইউর তদন্তে উত্থাপিত অনিয়মের সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদ সহমত পোষণ করে একটি চিঠি দিয়েছে।

জানা গেছে, বিএফআইইউর তদন্তে উত্থাপিত অনিয়মের বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চেয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি দেয় এসবিএসি ব্যাংক। সেখানে বলা হয়, পরিদর্শনে পাওয়া ব্যক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোয় সন্দেহজনক লেনদেন ছিল। তবে এই ব্যাংকের নিয়মিত তদারকিতে তা ধরা না পড়ায় আমরা দুঃখিত। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক থেকে অপর এক চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়, বিএফআইইউর তদন্তের সঙ্গে ব্যাংকের পর্ষদ সহমত পোষণ করেছে। বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করে পরিচালনা পর্ষদের পরবর্তী সভায় একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে প্রধান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন তৈরি করেনি ব্যাংক।

বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজয়নগর শাখার ভল্ট লিমিট মাত্র দেড় কোটি টাকা। অথচ গত বছর ৩১ জুলাই বিভিন্ন ব্যক্তির ৪৬টি এফডিআর নগদায়ন করে ২৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়। ওই দিন সন্ধ্যার পর মোহাম্মদ নেওয়াজের নামে একই শাখায় ২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকার ৯টি স্থায়ী আমানত খোলা হয়। সন্ধ্যা ৭টা ১৭ মিনিট থেকে ৭টা ৩৪ মিনিটের মধ্যে এই হিসাব খোলে শাখা। বিএফআইইউ মনে করে, দেড় কোটি টাকার ভল্ট লিমিটের শাখা থেকে বিপুল পরিমাণের অর্থ পরিশোধের বিষয়টি অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক। এসব লেনদেন প্রকৃত নয়, বরং কাগুজে। ৩১ জুলাই নগদায়ন করা ৪৬টি এফডিআরের অর্থের উৎস যাচাইয়ের জন্য গত বছরের ২৭ এপ্রিলের ক্যাশ রেজিস্টার পর্যালোচনা করে পরিদর্শক দল। এরপর একে একে বের হয় আরও বেনামি এফডিআরের তথ্য। গত বছরের ২৭ এপ্রিল ইকবাল হাসান সজল, মো. ডালিম, মো. সিরাজুল ইসলাম, মো. কাদের, মো. সুজন, মো. জাহিদ, মীর তানজিল আহমেদ, মো. নাইমুল হক নামে এফডিআর নগদায়ন ও ইস্যু করা হয়। একই রকম কাগুজে লেনদেনের বিপরীতে ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর ২৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকার ৩৪টি এফডিআর, ওই বছরের ২৭ জুলাই ২৫ কোটি ৫২ লাখ টাকার ৩৬টি এফডিআর, ২৭ এপ্রিল ২৫ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৩৪টি এফডিআর ও ১৯ জানুয়ারি ২৩ কোটি ৩২ লাখ টাকার ৩৮টি এফডিআরের তথ্য পেয়েছে তদন্ত দল। এর আগে ২০২০ সালের অক্টোবরে ৯ কোটি ১০ লাখ টাকার ২০টি এফডিআর খোলা হয়। ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি মেয়াদপূর্তির পর তা নবায়ন করা হয়। এরপর গত বছরের ২৭ জানুয়ারি আবার ১২ কোটি ২ লাখ টাকার ২১টি এফডিআর করা হয়।

সব এফডিআরে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে মোহাম্মদ নেওয়াজের। প্রতিটি ফরমেই গ্রাহকের ব্যক্তিগত ও নমিনি-সংক্রান্ত তথ্যের ঘর ফাঁকা রাখা হয়েছে। অর্থের উৎস বিষয়ে কিছু বলা নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্য কোনো পরিচিতির কপিও নেই। ভিন্ন ভিন্ন নাম হলেও সব ফরমে একই ব্যক্তি একই কালিতে সই করেছেন। শাখা ব্যবস্থাপক মো. ইসলামুল হক এবং শাখার হিসাব পর্যালোচনাকারী ও নিশ্চিতকারী কর্মকর্তা খন্দকার নূরে ইমাম এ স্বাক্ষর করে থাকতে পারেন বলে মনে করে বিএফআইইউ।

এসবিএসি ব্যাংকের বিজয়নগর শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইসলামুল হকের কাছে ভুয়া হিসাব খোলার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমে কিছু বলতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘এসব তেমন কিছু না। এসব মীমাংসিত কেস। এখন আর কিছু নেই।’ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই হিসাব খোলার কারণে তাঁকেও এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়– এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

নানা কারণে আলোচিত ২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া এসবিএসি ব্যাংক। এর আগে গত আগস্টে ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির মোল্লার লেনদেনসহ যাবতীয় তথ্য তলব করে বিএফআইইউ। ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা চলার মধ্যে গত বছরের নভেম্বরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ব্যাংকটির উদ্যোক্তা পরিচালক ও পিপলস লিজিংয়ের একসময়ের চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেন ঋণখেলাপির দায়ে পরিচালক পদ হারান। আরেক উদ্যোক্তা পরিচালক ও পিপলস লিজিংয়ের সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ঋণখেলাপির দায়ে ব্যাংকটির পর্ষদ থেকে বাদ পড়েছেন। খেলাপি হওয়ায় পরিচালক পদ হারিয়েছেন আরএসআরএম গ্রুপের কর্ণধার মাকসুদুর রহমান, শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছেন সাদ মুসা গ্রুপের মো. মহসিন। ব্যাংকটির আরেক পরিচালক মিজানুর রহমানকে পরিচালক পদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনাপত্তি না দিলেও আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে বহাল আছেন।  

সূত্র: সমকাল

গো নিউজ২৪

Link copied!