প্রশাসনের শীর্ষ পদে পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৩, ০৯:২০ এএম

প্রশাসনের শীর্ষ পদে পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে

সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে প্রশাসনের শীর্ষ পদে পদোন্নতিপ্রত্যাশীদের হতাশা বাড়ছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিবের নিয়মিত পদে অন্তত ৯ কর্মকর্তা এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। অর্থাৎ তারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ না পেলে সচিব হওয়ার যোগ্য সমানসংখ্যক নতুন কর্মকর্তা এ পদ পেতেন। এখন তারা বঞ্চিত।  এর বাইরে বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থা ও রাষ্ট্রদূত হিসেবে সচিব ও সচিব মর্যাদায় চুক্তিতে আছেন অন্তত ১৫ কর্মকর্তা। বর্তমানে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে কর্মরত ৮৬ কর্মকর্তা।

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রভাব পুলিশ বিভাগেও পড়েছে। সাধারণত আইজিপি বা র‍্যাবের ডিজি পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেখা যায় না। কিন্তু এ দুটি পদেও এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিচ্ছে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন-সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি বছর অন্তত ২৩ সচিবের অবসরে যাওয়ার কথা। জুলাই মাসের মধ্যেই অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ১২ সচিবের। গেছেন আট সচিব, বাকি চারজন, অর্থাৎ অবসরগামী এক-তৃতীয়াংশ সচিব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। চলতি মাস থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ১১ সচিবের অবসরে যাওয়ার কথা। এর মধ্যে থেকেও কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।

উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদের চেয়ে পদোন্নতির আধিক্য নিয়ে সরকারকে সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। তার পরও সচিব পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হচ্ছে। এতে হতাশায় ভুগছেন সচিব পদপ্রত্যাশী মেধাবী কর্মকর্তারা। সরকারি চাকরি থেকে ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যেতে হয়। মুক্তিযোদ্ধা হলে ৬০ বছর চাকরির সুযোগ আছে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই।

চুক্তি ঘিরে মেরূকরণ

প্রশাসনের শীর্ষ পদে সম্প্রতি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। তিনি প্রশাসনের নবম ব্যাচের কর্মকর্তা। এ পদটি বেসামরিক প্রশাসনের দ্বিতীয় শীর্ষ পদ। গত এক দশকে এ পদে দায়িত্ব পালন করা বেশির ভাগ কর্মকর্তাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। একই অবস্থা প্রশাসনের শীর্ষতম মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদে। বর্তমানে এ পদে দায়িত্বে থাকা প্রশাসনের অষ্টম ব্যাচের কর্মকর্তা মাহবুব হোসেনের ৫৯ বছর পূর্ণ হবে আগামী ১৩ অক্টোবর। বিশেষ ব্যতিক্রম না হলে তিনিও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন– এমন ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

এখানে অন্য হিসাবনিকাশের কথাও বলছেন কেউ কেউ। উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসনের আদর্শ পিরামিড কাঠামো অনুযায়ী বর্তমানে অষ্টম, নবম, দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে কোনো কারণে মাহবুব হোসেন নিয়োগ না পেলে এ পদে আসার সম্ভাবনা আছে জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব মেজবাহ্‌ উদ্দিন চৌধুরীর।

চুক্তিতে যারা, অপেক্ষায় কারা

পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, এনবিআর, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রতিরক্ষা, জননিরাপত্তা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। এর বাইরে এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশন, রাজউকসহ বেশ কয়েকটি অনিয়মিত পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দায়িত্ব পালন করছেন ডজনের বেশি কর্মকর্তা।

অন্যদিকে, প্রশাসনের ১৩ ব্যাচের কর্মকর্তারা সর্বশেষ সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এরই মধ্যে এ ব্যাচের ১৫ কর্মকর্তা সচিব পদোন্নতি পেয়েছেন।

দায়িত্বশীলদের ভাষ্য

সাবেক আমলা, বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, সরকারে আছি, সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা আমারও সিদ্ধান্ত। তাই এ বিষয়ে অন্য মন্তব্য করা অনুচিত। তবে এ পদ্ধতি থাকা উচিত কিনা সেটা প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন মনে করেন, সচিবদের নিয়মিত পদে যে কয়েকজন কর্মকর্তা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন, সেটা খুব বেশি নয়। তবে আইনসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সাবেক সচিবদের মধ্যে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন, তাদের নিয়মিত প্রশাসনের সঙ্গে মেলাতে নারাজ প্রশাসনের শীর্ষ এ কর্মকর্তা। তিনি সমকালকে বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পদ্ধতি থাকা না-থাকা নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তের বিষয়। এ ব্যাপারে আমি মন্তব্য করতে পারি না।’

চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘দেশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে উন্নয়ন কাজ চলমান। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা ব্যস্ত সময় পার করবেন। তখন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম যাতে ব্যাহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের প্রয়োজন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ সব সময়ই ছিল, এখানে অন্য কিছু চিন্তার সুযোগ নেই।’ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে নীতিমালা থাকা উচিত কিনা বা আদৌ এটার প্রয়োজন এখন আছে কিনা, সে বিষয় এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নয় বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ।

তবে এ ধরনের নিয়োগকে ‘অনৈতিক’ অভিহিত করেন সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান। তিনি সমকালকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে থাকার তদবিরকারীরা সরকারের পদলেহন করেন। তারা ভালো অফিসার নন। সরকার চাইলেও কোনো ভালো অফিসারের চুক্তিভিত্তিক থাকা উচিত নয়। তাঁর চুক্তির কারণে একজন স্বাভাবিক বয়সের অফিসার বঞ্চিত হন, এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

নির্বাচনের আগে বয়স শেষ হচ্ছে যাদের

বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত সচিবদের মধ্যে আগস্টের পর থেকে চাকরির স্বাভাবিক বয়স শেষ হবে কয়েকজনের। এর মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসানের ১৪ সেপ্টেম্বর, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব কে এম আবদুস সালাম ২৬ সেপ্টেম্বর, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ৯ অক্টোবর, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন ১৩ অক্টোবর, ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু বকর ছিদ্দীক ৩১ অক্টোবর, অর্থ বিভাগের ফাতিমা ইয়াসমিন ১৮ নভেম্বর এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শরীফা খানের ২৪ নভেম্বর অবসরে যাওয়ার তারিখ নির্ধারিত আছে।

কী হওয়া উচিত

প্রশাসনের শীর্ষতম পদ মন্ত্রিপরিষদ সচিব। এ পদটি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হওয়া উচিত বলে প্রশাসন পর্যবেক্ষকদের অভিমত। ভারতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব অন্তত দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান। সে দেশে এ পদে কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও সেটা চার বছরের বেশি হতে পারে না। এমন উদাহরণ বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বিভাগেও আছে। ‘প্রতিরক্ষা-বাহিনীসমূহের প্রধানদের (নিয়োগ, বেতন, ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা) আইন, ২০১৮’ অনুযায়ী সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানদের নিয়োগ চার বছর করা হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সদ্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেলে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন কোনোভাবেই এ পদে আসতে পারতেন না। এখন মাহবুব হোসেন যদি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, তাহলে কয়েকজন কর্মকর্তাকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিতে হবে। একই কথা মুখ্য সচিব পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এটা নিয়মতান্ত্রিক প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য নয়।’ তিনি বলেন, শীর্ষ পদগুলোতে সময় নির্দিষ্ট থাকলে কারও আক্ষেপ করার কারণ থাকবে না।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও লেখক ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘অসাধারণ দক্ষতার কারণে বিশেষ কোনো টেকনিক্যাল সেক্টরের জন্য মাঝেমধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রশাসনে এখন যেভাবে চুক্তির নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, সেটা সমর্থনযোগ্য নয়। এটা পেশাদার আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যকে খাটো করে।’ তিনি বলেন, যারা সারাজীবন চাকরি করে সচিব হওয়ার আশায় আছেন, তাদের স্বপ্নে বাধা হওয়া ঠিক নয়।

বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন ও এক মাসের মধ্যে সচিব হওয়ার শর্ত পূরণ করবেন এমন একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অপ্রয়োজনীয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য রাজনীতিকদের চেয়ে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাই বেশি দায়ী। তারা নিজেরাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে দৌড়ঝাঁপ করলে অন্যদের নিরুৎসাহিত করার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন।
সূত্র: সমকাল

গো নিউজ২৪

Link copied!