ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ৭ আগস্ট না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ডা. আলমিনা দেওয়ান মিশু। তার অকাল মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও সহকর্মীরা। দীর্ঘ ছয় বছরের কষ্ট আর ত্যাগের ফসল আসতে বাকি ছিল আর ছয়টা মাস। যে কারণে সংসারটাই ঠিকমতো করা হয়নি, সেই ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ উপাধি নামের পূর্বে যুক্ত হওয়ার আগেই পরপারে পাড়ি জমালেন তিনি।
ডা. আলমিনার দুই মেয়ে, বড়টির বয়স চার আর ছোটটির বয়স মাত্র দুই বছর। পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য স্বামী-স্ত্রী বহুদিন থেকেছেন আলাদা আলাদা জায়গায়। স্বামী-স্ত্রীর উচ্চতর পড়াশোনা, হাসপাতালের দায়িত্ব সবকিছু এক রকম গুছিয়ে এনেছিলেন তারা। পরিকল্পনা মাফিক ঢাকায় নিয়েছিলেন নতুন বাসাও। ইচ্ছা ছিল স্বামী-সন্তানদের নিয়ে একত্রে বসবাসের নতুন যাত্রা শুরু করবেন। কিন্তু হঠাৎ ঝড়ের মতো ‘ডেঙ্গু’ এসে তাদের সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেল।
ডা. আলমিনার স্বামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ সোয়েব আহমেদ। তিনিও রাজধানীর একটি বেসরকারি চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। স্ত্রী আলমিনাকে হঠাৎ হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক হয়ে পড়েছেন তিনি। জানালেন কীভাবে, কত কষ্ট করে জীবন-সংসার গুছিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন দুজনে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত ও চিকিৎসা
ডা. সোয়েব আহমেদ বলেন, ‘গত ২৪ জুলাই তার জ্বর এলো, পরদিন ডেঙ্গু টেস্ট করালাম এবং পাশাপাশি নাপা খাওয়াচ্ছিলাম। এরপর ডেঙ্গু রিপোর্ট আসার পর জানতে পারলাম ডেঙ্গু পজিটিভ। এ সময় প্লাটিলেট কাউন্ট দেড় লাখের মতো এবং হেমাটোক্রিট নরমাল। দ্বিতীয় দিনেও সে বাসায়, নাপা খাচ্ছে এবং এভাবেই চলছিল।’
‘বৃহস্পতিবার হঠাৎ বমি হলো এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসল। আমি তখন অপারেশন থিয়েটারে ছিলাম, এর মধ্যেই বাসা থেকে ফোন আসল এবং আমি বললাম তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে। এরপর তাকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমিও চলে গেলাম।’
ডা. সোয়েব বলেন, ‘মিশুর সঙ্গে আমার দেখা হলো ইমার্জেন্সিতে। তখনই সে আমাকে বলছিল, আমার অবস্থা খুবই খারাপ, হয়ত বাঁচব না, আমার মেয়ে দুইটাকে তুমি দেখে রেখো। আমি তখন তাকে আশ্বস্ত করলাম, তোমার তো ডেঙ্গু হয়েছে, এটা স্বাভাবিক বিষয়। তাছাড়া তোমার তো প্লাটিলেট কাউন্ট ভালো, সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। ওই সময়েও তার প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের মতো ছিল।’
ডা. আলমিনার স্বামী বলেন, ‘তাকে হাসপাতালে ভর্তির ৩ ঘণ্টা অবজারভেশন থাকার পরও জ্বর কমছিল না। এরপর তাকে নাপা ইনজেকশন দিলো, তখন আবার তার শরীর ঘামছিল। তিন ঘণ্টা পর দেখা গেলো তার অক্সিজেন সেচুরেশন কম। এরপর তাকে কেবিনে না দিয়ে এইচডিওতে দেওয়া হলো। সেখানে যাওয়ার পরই আবার তার খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। এরপর সিটি-স্ক্যান করা হলে দেখা গেলো যে সে ডেঙ্গু এনসেফালাইটিসে আক্রান্ত। এরপর তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়।’
‘পর দিন সকাল সাড়ে ৯টায় তার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড বসল। বোর্ডে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির, অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. রোবেদ আমিন, খ্যাতিমান স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ স্যারসহ অনেকেই। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে রোগীকে যত রকম অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, স্টেরয়েড দেওয়ার দিলেন।’
‘এরপর তারা ব্রেনে কতটুকু ড্যামেজ হয়েছে সেটা দেখলেন, ব্রেনের ফাংশন আছে কিনা, সেটাও দেখলেন। তখন তারা দেখতে পেলেন, ব্রেনের কিছুটা ফোকাল মুভমেন্ট হয়। কিছুটা নড়াচড়া করে, শ্বাস নিশ্বাস নেয়। এরপর তারা আরও কিছু মেডিসিন দিয়ে রোগীর ব্রেনটাকে রেস্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু এর দুই দিন পর দেখা গেলো যে আর রেসপন্স আসছে না। তার ব্রেন ফাংশনটা আর কাজ করছে না। এরপর একটা এমআরআই করা হলে দেখা যায় যে, তার ব্রেনে ব্লাড সার্কুলেশন নেই, যেটাকে ব্রেন ডেথ বলে।’
ডা. সোয়েব বলেন, ‘এভারকেয়ার হাসপাতালে ব্রেন ডেথ বলার পরদিন সকালে আবার আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানে আবার আর একটা বোর্ড গঠন করা হয়। তারাও বলল রোগীর ব্রেন কাজ করছে না, তবে তার অন্যান্য ফাংশনগুলো কিছুটা কাজ করছে। তারপর তার কিডনিতেও সমস্যা দেখা দিল। কিডনির আউটপুট কমে যাচ্ছিল। এরপর সেদিন রাতেই ১টার দিকে মারা গেলো।’
প্লাটিলেট কাউন্ট লাখের ঘরে, হেমাটোক্রিট নরমাল আসার পরও হঠাৎ করে কেন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৪ শতাংশের মতো এনসেফালাইটিস হয়ে থাকে, যা সরাসরি ব্রেনকে আক্রান্ত করে। জটিল ইনফেকশন তৈরি করে। প্রতি ১০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্তের মধ্যে ৩ থেকে ৪ জনের এই জটিলতা দেখা দেয়।’
দুজনেই কাজ-পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম
ডা. আলমিনার স্বামী বলেন, ‘ সংসারটা আসলে আমরা সেভাবে করতেই পারিনি। আমরা দুজনই স্টুডেন্ট ছিলাম। কাজের ফাঁকে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। যখন বিয়ে হয় তখন আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে। আমি চাকরি করতাম জামালপুর ইসলামিয়া আই হসপিটালে। সেখানে আমার ৫ বছর থাকার একটা কমিটমেন্ট ছিল। তাছাড়া আমার নিজ এলাকা জামালপুরে। এলাকার মানুষকে সেবা করার একটা সুযোগ ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমাকে সেখানেই থাকতে হলো। এর মধ্যে সে আবার ৩৯তম বিসিএস দিলো, সেটাতে সে টিকেও গেলো। এর আগে ৩৮তম বিসিএসে সে রিটেনেও টিকে গিয়েছিল, কিন্তু বাচ্চার তখন সাত দিন হওয়ায় সে ভাইভা দিতে পারল না। ৩৯তম বিসিএসের পর তার জয়েন হলো কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায়। তখন পাকুন্দিয়া, জামালপুর আর শ্বশুরবাড়ি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ হাওয়ায় তিন জায়গাতেই নিয়মিত আমাদের যাওয়া আসা হতো। একটা সময় পাকুন্দিয়া থেকে তার মাতুয়াইল পোস্টিং হলো। সেখানে আবার রাতেও ডিউটি করতে হতো। তখন সে যেত তাদের বাসা থেকে।’
‘এদিকে আমারও যখন জামালপুরে ৫ বছর হয়ে গেলো, আমিও ঢাকায় চলে আসলাম। ইসলামী আই হসপিটালের ঢাকা ব্রাঞ্চে ফেলোশিপে আসলাম, তারও ডিগ্রি শেষ হওয়ার কাছাকাছি চলে আসল। আমার ফেলোশিপ শেষ, আমি হাসপাতালটির রেটিনা বিভাগে জয়েন করব। সে জন্য আমরা পরিবাগ বাসাও নিলাম। বাসা নেওয়ার কয়দিন পরই সে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলো, এবং আমাদের রেখে চলে গেল।’
‘আমাদের আসলে সংসারটাই করা হয়নি। এতবছর সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়ে আসছি, এখন আমরা বাচ্চাদের সময় দেব, এর মধ্যেই আমার বাচ্চা দুইটা এতিম হয়ে গেল।’
‘ঢাকায় যখন ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে, বাচ্চাদেরও ডেঙ্গু বেশি হচ্ছে, তখন আমরা ভাবলাম বাচ্চাদের নানু বাড়িতে পাঠিয়ে দিই, আমরাই এখানে থাকি। তারপর বাচ্চাদের ঠিকই ডেঙ্গুর ভয়ে পাঠিয়ে দিলাম, কিন্তু এর মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেলো বাচ্চাদের মা। বাচ্চা দুইটা এভাবে এতিম হয়ে যাবে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।’
এক নজরে ডা. আলমিনা দেওয়ান
৩৯তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া এই চিকিৎসক রাজধানীর মাতুয়াইলে শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের স্ত্রী ও প্রসূতি রোগ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বিভাগটির আবাসিক শিক্ষার্থীও (এমএম কোর্স) ছিলেন তিনি।
আলমিনার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন বাজারে। শ্বশুর বাড়ি জামালপুরে। ২০১৭ সালে বিয়ে করেছিলেন তারা। সংসার জীবনে ২ ও ৪ বছর বয়সী দুই মেয়ে সন্তান ছিল তার।
আপনার মতামত লিখুন :