ভারত সরকারের লিফলেট

গর্ভকালে নারীর দৈহিক সম্পর্ক কি ক্ষতিকর?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশিত: জুন ২১, ২০১৭, ১১:৩১ এএম

গর্ভকালে নারীর দৈহিক সম্পর্ক কি ক্ষতিকর?

সম্প্রতি গর্ভবতী নারীদের মাংস এবং ডিম খাওয়া পরিহার করার পরামর্শ দিয়ে সারা দেশে গত বুধবার লিফলেট বিলি করেছে ভারত সরকার। সেই সঙ্গে গর্ভকালে শারীরিক সম্পর্ক থেকেও দূরে থাকতে বলা হয়েছে তাদের। এই লিফলেটে ছিল আরও বেশকিছু নির্দেশনা। এর কোনোটি ভাল, কোনোটি মন্দ, আবার কোনোটি একেবারেই হাস্যকর। আসলেই কি গর্ভকালে শারীরিক সম্পর্কে গর্ভবতীর কোনও ক্ষতি হয়?

গত সপ্তাহে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ার’ নামে ১৬ পৃষ্ঠার ছোট ওই লিফলেটটি বিতরণ করেছে ভারতের আয়ুশ মন্ত্রণালয়। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিকে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে মন্ত্রণালয়টি গঠন করে ভারত সরকার। এর পূর্ণ নাম, ‘আয়ুর্বেদ, যোগ, প্রাকৃতিক চিকিৎসা, ইউনানি, পবিত্রতা ও হোমিওপ্যাথি মন্ত্রণালয়’। সংক্ষেপে বলা হয় আয়ুশ। তিন বছর ধরে মন্ত্রণালয়টি খোলা হলেও বাৎসরিক আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালন করে গণমাধ্যমে ভালোই পরিচিতি পেয়েছে।

বুধবার তাদের বিতরণ করা লিফলেটে ছিল গর্ভবতী নারীদের যোগ ব্যায়াম সংক্রান্ত পরামর্শ। এতে গর্ভবতীদের কোন খাদ্য খাওয়া উচিৎ, কোন খাদ্য পরিহার করা উচিৎ- এসব বিষয়ে নির্দেশনা ছিল। এছাড়া গর্ভকালে তারা কাদের সঙ্গে মিশবেন, কাদের সঙ্গে মিশবেন না, কোন ধরনের ছবির দিকে তাকাবেন না- এমন আরও অনেক বিষয়ে পরামর্শ ছিল লিফলেটে।

ভারত সরকারের ওই পরামর্শে নারীদের ‘অপবিত্র চিন্তা’ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সুন্দর শিশুদের ছবির দিকে না তাকানোর কথা বলা হয়েছে। ওই লিফলেটে লেখা ছিল, ‘গর্ভবতী নারীদের কামনা, রাগ, মিলন, ঘৃণা এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেদের দূরে রাখা উচিৎ।’ আর এর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তাদের মন্ত্রীও।

এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের চিকিৎসকরা। তারা একে ‘ভ্রান্ত’ ও ‘বিপজ্জনক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ভারত ইতিমধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। এমনিতেই দেশটির পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঐতিহ্যগভাবে খাওয়া-দাওয়া এবং স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে নারীরা থাকে সবার শেষে।

ভারত সরকারের বিলি করা লিফলেট

ভারতীয় গাইনি বিশেষজ্ঞ অরুণ গাদ্রে বলেন, ‘দরিদ্র নারীদের পুষ্টিকর এবং উচ্চপ্রোটিনযুক্ত খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করার পরিবর্তে সরকার তাদের ওপর অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক পরামর্শ চাপিয়ে দিচ্ছে।’ সরকারের এই পরামর্শকে ‘জাতীয় লজ্জা’ বলেও অভিহিত করেছেন গাদ্রে।

অন্য চিকিৎসকরা বলেন, এসব পরামর্শের কিছু ভালো দিক রয়েছে। তবে আবার অনেক খারাপ দিকও রয়েছে। বিশেষ করে খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি। লিফলেটে গর্ভবতী ও যেসব নারী সন্তানদের বুকের দুধ পান করাচ্ছেন তাদের সিম, মটরশুটি, ফল, সবজি এবং জুস খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এগুলোকে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে আখ্যা দেন চিকিৎসকরাও।

তবে খাবারের তালিকায় বাদ দিতে বলা হয়েছে: চা, কফি, চিনি, মসলা, সাদা ময়দা, ভাজা খাবার এবং এই তালিকায় সবচেয়ে বিতর্কিত হচ্ছে ডিম এবং অন্যান্য আমিষ না খাওয়ার পরামর্শ দেয়া।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি সরকারের নিরামিষ ভোজনের নীতি ছড়িয়ে দিতে এ ধরনের পরামর্শ বিপজ্জনক। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাতৃমৃত্যুর হার ভারতে। অপুষ্টি আর রক্তস্বল্পতাই প্রধানত এর জন্য দায়ী। ২০১৫ সালের জরিপ মতে, ভারতে প্রতি ১ লাখ গর্ভবতীর মধ্যে ১৭৪ জনই সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মারা যায়। পাঁচ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল ২০৫। তবে এখনও চীনের চেয়ে অনেকখানি পিছিয়ে আছে দেশটি। চীনে প্রতি ১ লাখে ২৭ জন গর্ভবতী সন্তান জন্ম দেয়ার সময় মারা যান।

সমালোচনায় পড়ে আলাদা বিবৃতি দিয়েছে ভারতের আয়ুশ মন্ত্রণালয়। তারা জানিয়েছে, যোগ ব্যায়াম এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি আমিষ খাওয়া সমর্থন দেয় না। এজন্যই তারা এগুলো পরিহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এছাড়া অনেক ভালো উপদেশ প্রচার না করে ডিম এবং মাংসের বিষয়টি গণমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবে তুলে ধরেছে বলেও তাদের অভিযোগ।

তবে শুধু গণমাধ্যমই নয়, ভারত সরকারের এই পরামর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও। ভারতীয় গাইনি বিশেষজ্ঞ সোনিয়া নায়েক বলেন, ‘একজন চিকিৎসক হিসেবে নারীদের ডিম, মাংস পরিহার করতে বলার মধ্যে আমি কোনও মঙ্গল দেখি না। ডিম হচ্ছে প্রোটিনের সবচেয়ে সহজলভ্য এবং সবচেয়ে ভাল উৎস। আমার পরামর্শ হচ্ছে তাদের এটা খাওয়া উচিৎ।’

আয়ুশ মন্ত্রণালয়ের বিলি করা লিফলেটে আরও অদ্ভুত হচ্ছে- এখানে নারীদের গর্ভধারণের পর সব ধরনের যৌনতা এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। সব ধরনের কামনা এবং যৌর আকাঙ্ক্ষা থেকে বিরত থাকার জন্যও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে চুপ ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়। তবে চিকিৎসকরা বলেন, গর্ভকালে যৌনমিলনে কোনও ক্ষতি হয় না।

ডা. নায়েক বলেন, ‘হরমোনজনিত কিছু কারণে অনেক গর্ভবতী নারীই গর্ভকালে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে বেশি যৌনতা চায়। গর্ভবতীর কোনও উচ্চঝুঁকি না থাকলে আমরা তাদের এই কাজ থেকে বিরত থাকতে বলি না।’

আগে মনে করা হতো, গর্ভকাল হচ্ছে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি সময়। এই সময়ে মেয়েদের বিশ্রামই নেয়া উচিৎ। তবে সময়ের সঙ্গে এই ধারণা পাল্টেছে। এখন চিকিৎসকরা গর্ভবতীদের নিয়মিত কিছু ব্যায়ামের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসময় মেয়েরা চাইলে যোগ ব্যায়ামের মতো কিছু ব্যায়াম করতে পারে বলে জানান ডা. নায়েক।

গো নিউজ২৪/ আরএস

গো নিউজ২৪

Link copied!