হাসপাতালে ১৫৬ দিন থেকে বাসায় ফিরে শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ আছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত ১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তার গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’য় ফেরেন তিনি। মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাসাতেই তার চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে। এভারকেয়ার থেকে ফেরার পর সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর কোনও রোগের নতুন উপসর্গ দেখা দেয়নি। উপরন্তু, চিকিৎসকদের পরামর্শে তিনি বাসাতেই অল্পবিস্তর হাঁটাচলা করছেন।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসক, মেডিক্যাল টিমের সহকারী ও চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের একাধিক সূত্রের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে উন্নত। বিদায়ী বছরের ২৬ অক্টোবর তার চিকিৎসায় যোগ দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স হাসপাতালের তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তাদের চিকিৎসার পরই খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে বলে জানান তার চিকিৎসক দলের একজন সদস্য।
বিদায়ী বছরের ৯ আগস্ট এভারকেয়ারে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রাজধানীর এভারকেয়ার থেকে অনেকটাই হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় বাসায় ফেরেন বিএনপির চেয়ারপারসন। সেদিন তিনি হাসপাতাল থেকে হুইল চেয়ারে নেমে আসেন গাড়ির সামনে। এরপর দাঁড়িয়ে উঠে গাড়িতে প্রবেশ করেন তিনবারের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী। গাড়িতে ওঠার পর ভেতরেও তাকে চনমনে দেখা যায়। দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়াকে সচকিত পেয়ে নেতাকর্মীরাও উৎফুল্ল।
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, বাসায় ফেরার পরও বেগম জিয়াকে উৎফুল্ল দেখা গেছে। গাড়ি থেকে নেমেই ভাগ্নে অভীক ইস্কান্দারের মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন তিনি।
পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘ম্যাডামের শরীর আগের চেয়ে অনেক ভালো। বিশেষ করে আমেরিকার তিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা করার পরই দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সেই চিকিৎসকরাই তাকে হাঁটার পরামর্শ দেন।’
চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ম্যাডামের শারীরিক অবস্থা একটু উন্নত রয়েছে। ২৬ অক্টোবর বাসায় ফেরার পর থেকে নতুন কোনও উপসর্গ দেখা দেয়নি।’
পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া বর্তমানে বাসায় থাকলেও পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য দেশের বাইরে রয়েছেন। বর্তমানে শামীম ইস্কান্দারের পরিবার রয়েছে তার দেখাশোনায়।
চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কেউ নিজ পরিচয়ে উদ্ধৃত হতে রাজি হননি। ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনকেও ফোনে পাওয়া যায়নি।
পরে খালেদা জিয়া একান্ত সহকারী আবদুস সাত্তার বলেন, ‘ম্যাডাম শারীরিকভাবে এখন ওভারঅল খারাপ। কিন্তু বেঁচে আছেন। খাওয়া-দাওয়া কমবেশি করতে পারেন, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ।’
এর আগে, ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তির পর ওই বছরের ৭ নভেম্বর বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। তখন তার শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। ছয় দিন পর আবারও ১৩ নভেম্বর হাসপাতালে ফিরতে হয় তাকে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর থেকে অসুস্থতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। বন্দি থাকা অবস্থায় তিনি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফিরে আসেন খালেদা জিয়া।
২০২১ সালের ১১ এপ্রিল করোনাভাইরাসের নমুনা টেস্ট রেজাল্ট ‘পজিটিভ’ আসে খালেদা জিয়ার। ২৭ এপ্রিল রাতে তাকে রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৮ এপ্রিল বিএনপি-প্রধানের চিকিৎসার জন্য ১০ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৯ জুন রাতে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ফেরেন বেগম জিয়া।
২০২১ সালের ১৯ জুলাই মহাখালীর শেখ রাসেল ন্যাশনাল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হাসপাতালে করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেন বিএনপি-প্রধান। ১৮ আগস্ট টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেন তিনি।
দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। ক্রমাগত শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন তিনি। ২৫ অক্টোবর তার শরীর থেকে নেওয়া টিস্যুর বায়োপসি করা হয়। ৩১ অক্টোবর বায়োপসি রিপোর্ট হাতে পায় মেডিক্যাল বোর্ড। ২৭ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া।
তৃতীয় দফায় ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর এভারকেয়ারে ভর্তি করানোর পর সেদিন রাতেই সিসিইউতে নিতে হয় খালেদা জিয়াকে। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই পর্যায়ে এসে বেগম জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি চূড়ান্ত খারাপ হয়। এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে ২৮ নভেম্বর (সোমবার) খালেদা জিয়ার ছয় জন চিকিৎসক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে তার পরিস্থিতির কথা জানান। প্রথমবারের মতো চিকিৎসকরা সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর লিভার সিরোসিসের বিষয়টি প্রকাশ করেন। তার অন্যতম চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান, বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মিলিয়ে অন্তত ১৭-২৩ জন চিকিৎসক কাজ করেছেন বেগম জিয়ার মেডিক্যাল টিমে।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যাওয়ার প্রায় দুই বছর পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় পারিবারিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ছয় মাসের জন্য শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর প্রতি ছয় মাস অন্তর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তির মেয়াদ বাড়ায় সরকার। সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে মেয়াদ নবায়ন ও প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী মার্চে। সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
আপনার মতামত লিখুন :