লাল বল। একটুকরো হলুদে কাগজ। এই লাল–হলুদের ‘হাইফেন’–এ জুড়ে এক হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু হল। ‘স্যান্ডপেপার’ কাণ্ডে! লাল বলে হলদে কাগজ ঘষে দিয়েই লুকিয়ে ফেলবে। ইচ্ছে ছিল সেটাই। কিন্তু গোপনীয়তার শর্তই হল, বেশি করতে গেলেই বেশি বেশি ভুল হয়। হলও তাই। পকেটের বদলে ট্রাউজার্সের আরও গোপন জায়গায় লুকিয়ে ফেলতে চেয়েছিল হলদে কাগজটা। কিন্তু সে যে ক্যামেরার নির্ভুল নিশানায়, জানত না ছেলেটা (আপাত নিঃষ্পাপ মুখের ছেলেটিকে ‘আপনি’ বলতে যেন কেমন লাগে) না। অতঃপর বমাল সমেত ধরা পড়া। হইচই। হলুদ টেপ বলে মিথ্যে ঢাকার চেষ্টা। শেষে স্বীকার। শেষমেশ নির্বাসন ৯ মাসের।
ওর বয়স ২৫। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্টম্যাচ খেলেছেন মাত্র ৮টা। অথচ এত বড় স্পর্ধা? মনে এত চুরি? ছিঃ! এমনটাই মনে হবে ক্রিকেট প্রেমিদের কাছে। কিন্তু ক‘জনে জানেন তার অন্ধর মহলের কথা? তাহলে এখন একটু সময় ব্যয় করে জেনে নিন এক হতভাগা অজি ক্রিকেটার ক্যামেরন টিমোথি বেনক্রফট সম্পর্কে ।
জানি, জানার পর গোটা ক্রিকেটবিশ্ব প্রতিক্রিয়ায় ওই একটিই শব্দই থাকবে। কিন্তু ওই একটা শব্দে কি চেনা যায় ব্যানক্রফটকে? পরিশ্রম তো কোনওকালেই ‘ছিঃ’–এর সমার্থক নয়। ক্রিকেট–পাগল মন ছুঁতে ওই শব্দটা ব্যবহার করা যায় না। কঠিনতম মুহূর্তে অন্যের যন্ত্রণা যার চোখে বড় লাগে, তাকে বুঝতেও শব্দটা লেখা যায় না।
ব্যানক্রফট কে? তাকে বুঝতে কতটা সময় অপচয় করা যায়?
জাতীয় দলের দুই সিনিয়র। একজন ক্যাপ্টেন। অন্যজন ভাইস ক্যাপ্টেন। নির্দেশ দিয়েছেন। অস্বীকার করার উপায় আছে? থাকলেও কি তা এক প্রায় নবাগতের জানা? পোড়খাওয়া স্টিভ স্মিথ ‘ব্রেন–ফেড’ হন। ব্যানক্রফট হতে পারে না? নাকি বয়স, অভিজ্ঞতায় ছোট বলে তার ওপর ‘চোর’ লেবেল সেঁটে দেওয়া সহজ? আপনারা হয়ত বলবেন, ব্যানক্রফট চোর। তাকে ভেঙে দাও, নির্বাসনে পাঠিয়ে দাও। তাতে এক তরুণের ক্যারিয়ার গোল্লায় গেলে যাক।
নেট থেকে একরকম জোর করে তুলে আনতে হয় ট্রেনিংয়ের ভূত মাথা থেকে তাড়াতে। দল নির্বাচন। বাকিরা ব্যস্ত বিয়ারের গ্লাসে চুমুক মারতে আর সসেজে কামড় দিতে। ব্যানক্রফট ব্যস্ত কোণে দাঁড়িয়ে গভীর মনযোগে ব্যাটে বল নাচানোয়। কোনও হুঁশ নেই। সেই মুহূর্তে জীবনটাই জাগলিং। ছেলেটা এমনই। তারপরেও হয়ত আপনারা বলবেন, কী আসে–যায় তাতে?
ডার্বি কাউন্টি বনাম নটিংহ্যাম ফরেস্টের ম্যাচ। বন্ধু জো–কে উত্ত্যক্ত করতে ফরেস্টের টি–শার্ট কিনে হাজির ব্যানক্রফট। নটিংহ্যাম ফরেস্ট গোল করলেই জো–কে ওই জার্সি পরতে বাধ্য করা হয়। বন্ধুকে চটিয়েই পরের মুহূর্তে ফিরিয়ে দেওয়া অনাবিল হাসি। রাগ–টেনশন ধরাশায়ী এক ফ্রেমে। ক’জন পারে করতে? ছেলেটা পারে। ছেলেটা এমনই। কী আসে–যায় তাতে?
হেনর থেকে ডেনবি। ছুটে যাওয়া জুনিয়র টিমের জন্য। ক্রিকেট কিট, ক্রিকেট বল দেওয়াটা আসলে একটা অজুহাত। আসল হল জুনিয়রদের উৎসাহ দেওয়া। বয়সটা নিজেরও কমের দিকেই। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। ছোটদের কিছু শেখাতে পারলেই সুখ। ছেলেটা এমনই। কী আসে–যায় তাতে?
অ্যাশেজের আগে বন্ধুর অনুরোধ, ‘ক্যামেরন, অন্তত একটা টেস্টে আমাদের জিতিয়ে ফিরো।’ জাতীয় দলের ক্রিকেটারের পাল্টা রোখা জবাব: ‘একটা? ৫–০ জিতে ফিরব। দেখে নিও।’ শুনেই মনে হয়, আত্মবিশ্বাসের চূড়ান্ত। ঠিকই তো। ছেলেটা এমনই। কী আসে–যায় তাতে?
প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার জাস্টিন ল্যাঙ্গারের কথায়, ‘পৃথিবীতে কাউকে ওর চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে দেখিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার জন্য এতটা মরিয়াও কাউকে দেখিনি।’ জহুরির চোখ কি না বলা কঠিন। তবে ছেলেটা তো এমনই। পরিশ্রমের মূর্তিমান প্রতিশব্দ! কী আসে–যায় তাতে?
দুনিয়ার চোখে এখন অবশ্য সে ‘চোর’, ‘প্রতারক’। টানা ৯ মাসের নির্বাসন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সতীর্থ মাইকেল ক্লিঙ্গার লিখলেন, ‘বন্ধু, খালি তোমার কথাই ভাবছি’। নির্বাসিত জবাব দিল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ বন্ধু। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার যে অভিজ্ঞতা হল, তার থেকে অনেক অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ আর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তোমার স্ত্রী সিন্ডি’। কেন ছেলেটা বলল সিন্ডির কথা? কারণ, ক্লিঙ্গারের স্ত্রী সিন্ডির মাস কয়েক আগে স্তন ক্যান্সার ধরা পড়েছে। নিজের পেশাদারি জীবনে যখন চরম বিপর্যয়, তখনও ছেলেটা ভাবছে বন্ধুপত্নীর জীবনের লড়াইয়ের কথা। ভাবছে, তার চেয়ে অন্যের লড়াই আরও কঠিন। এই জগতে তো কেউ নিজেদের বাইরে ভাবেই না। ছেলেটা ভাবে। ছেলেটা এমনই। কী আসে–যায় তাতে?
সত্যিই, কী বা আসে–যায়।
পাশে মা ছিলেন বটে। কিন্তু সেটা সম্ভবত মানসিক বলবর্ধনের জন্য। নইলে ২৫ বছরের যুবক নিজের কথা নিজেই বলতে বেশি ভালবাসে। যেমন নির্বাসন ঘোষণার পর সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে প্রাথমিক প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, ‘আমি (জাতীয় ক্রিকেট দলে) নিজের জায়গাটা এত হেলায় অন্যকে দিয়ে দিলাম। কাউকে কোনও পরিশ্রমই তো করতে হল না আমার জায়গাটা পেতে। অথচ আমি নিজে এই জায়গাটা পেয়েছিলাম প্রচণ্ড পরিশ্রম করে। এই কথাগুলো যখনই ভাবছি, মন ভেঙে যাচ্ছে। এই ভাবনাটাই আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।’
কত যন্ত্রণায়, কতটা ফুরিয়ে, কতখানি নিজেকে হারিয়ে ছেলেটা দেশীয় সাংবাদিকদের কাছে কথাগুলো বলেছে, সেটা অবশ্য কেউ ভাববে না। ভাববেই বা কেন? এমন কোনও রেওয়াজ তো এই দুনিয়ায় নেই। নামের সঙ্গে ‘চোর’ পদবি জুড়লে বাকি সব পরিচয় নিয়ে আর কেউ মাথা ঘামায় না। মুছে যায় অতীতের পরিশ্রম। মুছে যায় কৈশোরের লড়াই। ধুয়ে যায় যাবতীয় চেষ্টা। নিভে যায় যাবতীয় স্বপ্ন। প্রাক্তন খেলোয়াড়রা টিভি–র অনুষ্ঠানে জীবন্ত ক্রিকেটারের শব ব্যবচ্ছেদ করেন। কঠিন আর কঠোর শোনায় তাদের গলা। গোটা দেশে সমবেত হাহাকার ওঠে। সঙ্গে সমস্বরে ধিক্কার।
সাংবাদিক বৈঠকে শূন্যদৃষ্টি ছেলেটির কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা একহারা চেহারাটা। আম্পায়ারদের কাছে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আপাত–ব্যর্থ চেষ্টা। ক্রমশ ভেঙে পড়া। আবার উঠে দাঁড়ানো।
মনে হচ্ছিল, কাকতালীয় হলেও ছেলেটার নামের সঙ্গে জোড়া আছে একটা শব্দ। দিনশেষে যা ভয়ঙ্কর সত্যি।
ক্যামেরন টিমোথি ‘ব্যান’ক্রফট ফিরে এসো আবার নতুন করে। ফিরে এসো আবার পরিশ্রমের মাধ্যমে। সব শেষে বলবো, ফিরে এসে আবার চ্যালেঞ্চ নিয়ে উচ্চ মর্যদায় নিয়ে যাও নিজের দেশকে। এই হোক তোমার প্রতিজ্ঞা। আর তাতে হয়ত মুছে যাবে মানুষের এই ডায়ালগটি। কী আসে–যায় তাতে?
পূর্ণ নাম: ক্যামেরন টিমোথি বেনক্রফট,জন্ম ১৯ নভেম্বর ১৯৯২ (বয়স ২৫) আতাডেল, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া।
ব্যাটিংয়ের ধরন: ডানহাতি।
বোলিংয়ের ধরন: ডানহাতি মিডিয়াম।
ভূমিকা: ব্যাটসম্যান
মাঝে-মধ্যে উইকেট-কিপারও করেন।
টেস্ট অভিষেক: ২৩ নভেম্বর ২০১৭ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।
ম্যাচ: আটটি।
রান: ৪০২।
গোনিউজ২৪/এএস
আপনার মতামত লিখুন :